বাংলাদেশ
পরীক্ষামূলক প্রচার
01-Jul-2024
নারী ও বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতি
সফিউর রহমান
নারী ও বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতি

১. নারী মুক্তি বিষয়ে তত্ত্ব আওড়িয়ে নিজেকে পন্ডিত হিসেবে জাহির করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। প্রগতিশীল রাজনীতিকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরাও লক্ষ্য নয়। বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতিতে নারীর অবস্থান আরো পোক্ত করে এবং এই বিষয়ে বাধাগুলো প্রায়োগিক জায়গা থেকে চিহ্নিত করার  আন্তরিক সীমিত প্রয়াস থেকেই এই লেখার জন্ম।

যে সমাজকে আমরা বদলাতে চাই, আমরা সেই সমাজের হাতেই তৈরি। ফলে নিজের অজান্তেই আমরা তার দেয়া পদ্ধতি ধরে ভাবি। প্রগতিশীল রাজনীতিসহ সমাজের যে কোন ক্ষেত্রেই এই কথা সত্য। বিভিন্ন সময়ে এবং এখন পর্যন্ত যারা মানুষ ও প্রকৃতির মুক্তির লক্ষ্যে রাজপথে সরব সক্রিয় আছেন,  সে সব নারী ও পুরুষ প্রগতিশীল রাজনীতিতে নারীর অবস্থান নিয়ে যে সব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, তাদের মতামতের সঙ্কলন হিসেবে এই লেখা পাঠ করতে হবে।সঙ্গত কারণেই তাঁদের নাম - পরিচয় উল্লেখ করার সুযোগ নেই।

কবুল করে নিই যে, এসব অভিজ্ঞতা ঢালাওভাবে সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। সেই ব্যতিক্রমিদের সালাম জানিয়ে লেখা শুরু করছি।  

২. আমরা দেখেছি, নারী শাখার সভাগুলো সাধারণত ছুটির দিনে ডাকা হয়। এগুলোতে অংশ নেয়া নারী কমরেডদের অনেকেই এতে ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। সংসার, পরিবার ছেড়ে বন্ধের দিনে মিটিং করতে কোন দায়িত্বশীল নারী স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন না। তারা বলেন, “বন্ধের দিনে পরিবারে অনেক কাজ থাকে। সন্তানের দেখ-ভাল, বাজার করা, সবাই মিলে একত্রে খাওয়া, পারিবারিক নানা বিষয় নিয়ে স্বামীর সাথে মত বিনিময় করার সুযোগ বন্ধের দিনেই পাওয়া যায়। ভবিষ্যৎ বৈষয়িক জীবনের নিরাপত্তা বিধানের মত সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত এই দিনেই নেয়া যায়। এই বন্ধের দিনে মিটিং করা মানে পুরো পরিবারকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়া।“ কথা প্রসঙ্গে তারা অনেকেই বললেন যে, কোন নারী, তাঁর স্বামী সন্তান কেউই আলাদা থাকতে চান না। এহেন সাধারণ এবং জরুরি বিষয়টি বোঝার মত সংবেদনশীলতা প্রগতীশীলদের নেই – এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাহলে একজন নারী ও তাঁর পরিবারকে কেন এই প্রতিকূল অবস্থায় পড়তে হয়? এর উত্তর যা পাওয়া গেল তা খুবই আশ্চর্যজনক! একজন নারী কমরেড বললেন, “আমাদের নেতাদের বউ, মেয়েরা তো কেউ পার্টি করে না, পার্টিতে আসেও না। নিজেদের বউ মেয়েদের ঘর বন্দি করে রেখে, অন্যদের বউ মেয়ে নিয়ে ছুটির দিনে মিটিং করতে তো সমস্যা নেই”।

৩. অনেকে বলেন, “নারীকে মিটিং মিছিলের শোভাবর্ধনকারী হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা লক্ষণীয়, যা খুবই দুঃখজনক। এই মনোবৃত্তির মধ্য দিয়ে নারীকে পণ্য হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়। বিজ্ঞাপণওয়ালারা নারীকে একভাবে বিক্রি করে আর আমাদের প্রগতিশীল  রাজনীতি নারীকে  বিক্রি করে রাজনীতির মাঠে”।

জোরালো অভিযোগ আছে যে, নীতি নির্ধারণে নারীদের কণ্ঠকে চাপিয়ে রেখে তাদের কেবল চাঁদা তোলার কাজে ব্যবহার করা হয়। পার্টিতে আসা নারীদের ক্রমাগত বলা হয়, পরিবার, রাষ্ট্র এসব হল পুরুষতান্ত্রিক, নারীর বিকাশের পথে বাঁধা। এই পুরুষতান্ত্রিক পরিবার, রাষ্ট্রকে ভেঙে নারীকে মুক্ত করতে হবে। একজন নারীকে স্বাধীনভাবে নিজের মত ভাবতে না দিয়ে নারীকে দিশাহীন করে দেয়া হয়। দিশাহীন নারী  অজান্তেই নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। পরিবারে শুরু হয় টানা-পোড়েন। এর কোন সৃজনশীল সমাধান আমাদের উদ্দিষ্ট প্রগতিশীল মহলে নেই। পরিবারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা নারী এক পর্যায়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। যেখানে রাজনীতিতে নারীর সাথে তার পরিবারের অংশগ্রহণের ব্যাপক সুযোগ ছিল, তা প্রতিকূল হয়ে ওঠে।

আবার কোন নারী যদি তাঁর দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে কোন পুরুষ কমরেডকে সময় বা অর্থ দিয়ে সহায়তা করে থাকেন, তখন সেই সহায়তা পাওয়া পুরুষ ভাবতে থাকেন – আরে, এ তো সহজলভ্য! দাও এবার সময়-অসময়ে ফোন। বিপ্লব, পার্টির নামে নানা প্যাঁচাল, ছলে, কৌশলে নারীর সময় কেড়ে নেয়া সেই পুরুষের নেশা হয়ে ওঠে। ফাঁক পেলেই বলেন – আরে কমরেড চলেন, অমুক জেলা টুর করে আসি, আপনি ছাড়া সংগঠন দাঁড়ায় নাকি! অথচ তার নিজের বউ বা বোন থাকেন ঘরবন্দি, তাঁদের রাজনীতিতে নিয়ে আসার কথা কিন্তু মনে হয় না। এমন আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক নারী শেষ পর্যন্ত পার্টি ছেড়ে দেন।

কোন নারী তাঁর পরিবার দীর্ঘ সময় ছেড়ে থাকলে কী প্রভাব ঐ নারীর জীবনে পরবর্তিতে পড়তে পারে – এই রকম ভাবনা আমাদের প্রগতিশীল বয়ানে অনূপস্থিত বলে মনে হয়।

একজন সম্ভাবনাময় নারীকে দিকনির্দেশনা দেয়া, যথা সময়ে তাঁকে নিজ পরিবার গড়ে তোলার পরামর্শ দেয়ার রেওয়াজ এই মহলে নেই। ফলে অনাগত এবং নিশ্চিত নিঃসঙ্গতা ভবিষ্যতে তাঁকে অসহায় করে দেয়।

কোন নারী কারণবশত পার্টি ছেড়ে চলে গেলে, যথারীতি তাঁর বিরুদ্ধে সুবিধাবাদ, ইত্যাদি অপবাদে তাঁর বিগত সমস্ত অবদান অস্বীকার করা হয়। একজন নারী বা পুরুষ নানা কারণেই পার্টি ছেড়ে দেওয়ার এক্তিয়ার রাখেন। তাই বলে তাঁদের প্রতি এমন আক্রোশ কোন রাজনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না।

৪. নারী মুক্তির প্রশ্নটি অনেক ক্ষেত্রে অন্যসব মুক্তির অধীনস্ত বিষয় হিসেবে হাজির করা প্রগতিশীল রাজনীতিতে একটি চলমান অভ্যাস। যেন অন্যসব মুক্তির বাস্তবায়নের অধীনেই এর সম্ভাবনা নিহিত। এই অধীনস্ততাও  সমাজে নারীর বহাল অধীনস্ততার আরেক বয়ান মাত্র। আমাদের আমলে নিতে হবে যে, নারী মুক্তি সমাজ মুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত কিন্তু অধীনস্ত নয়।

৫. নারী প্রথম বীজ বপন করে সভ্যতার জন্ম দেয়। নারী শিখিয়েছিল ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য মজুদ করতে। নারী জন্ম দেন শ্রমিক, কবি, রাজনীতিবিদ, শিল্পী, ভাবুক আর চিন্তক। নারীর মধ্যে রয়েছে সম্ভাবনাকে ভাব থেকে বাস্তব করে তোলার অসীম ক্ষমতা। তাঁর ক্ষমতাকে চিনতে শিখি, স্বীকার করে নিই। আসুন, আমরা জয়ধ্বনি দিই নারীর নামে।




সফিউর রহমান
সফিউর রহমান
লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী

সর্বশেষ

নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা

জনপ্রিয়

মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
নীতুর লিপস্টিক
নীতুর লিপস্টিক