বাংলাদেশ
পরীক্ষামূলক প্রচার
29-Jun-2024
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা
সালাহ উদ্দিন শুভ্র
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা

তাসনীম খলিল একজন প্রবাসী সাংবাদিক। তার বা তার পোর্টালের করা নিউজ আমরা দেখি ও পড়ি। দেশজুড়ে কিছু কিছু সেনসেশনও তৈরি হয় তাদের খবরগুলো নিয়ে। এর বাইরে তাসনীম খলিল বিভিন্ন বিষয়ে ফেসবুকে সরব। সম্প্রতি তিনি সরব হয়েছেন বাংলাদেশের একুশে বইমেলায় কলকাতার বই আসা প্রসঙ্গে। যদিও তাসনীম খলিল পুরো বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম না করেই তর্কে নেমে পড়েছেন এবং এ ইস্যুর সংকটকে সক্রিয় লেখকদের ‘ইনফেরিয়রিটি’ হিসেবে সাব্যস্ত করতে চেয়েছেন।

কলকাতার বই বাংলাদেশে আসা নিয়ে যে তর্ক বা আপত্তি তা দীর্ঘদিনের। এবং এ ইস্যুতে লেখকদের বিভক্তিও দৃশ্যমান।যারা সব জেনেশুনে ভারতের বই বাংলাদেশে আসা বা একুশে বইমেলায় তাদের প্রকাশকদের অংশগ্রহণের পক্ষে থাকেন তাদের ভারতপন্থী বলা হয়। এ নিয়ে আলাপ-তর্ক-ঘটনার মধ্যে নতুন হয়ে দেখা দিলেন তাসনীম।

মুক্তিযুদ্ধের পর আহমদ ছফা থেকে শুরু করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলি, হুমায়ূন আহমেদদের যে কলকাতার সঙ্গে একটা ফাইট সবসময় করে যেতে হয়েছিল, তাও অজানা কোনো ঘটনা নয়। নতুন করে এসব নিয়ে বলার কিছু নেইও। বরং তাসনীম খলিলকে নিয়ে বলা প্রয়োজন।


খলিল লিখেছেন: "ঢাকার শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ ফালতু একটা কলকাতা-ফোবিয়ায় ভোগেন। এদের হীনমন্যতা চোখে লাগে। এইসব ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স থেকে বাইর হোন, নাইলে ইনফেরিয়রই থেকে যাবেন " —তাসনীম খলিল, ২৬/০২/২৩

খলিল শুরুতেই যেভাবে লেখকদের ইনফেরিয়র বলে কনডেম করলেন তা রীতিমতো অভব্যতা। একটা বিষয় ভালো না জেনে, না বুঝে; বাংলাদেশের লেখকরা যে অমর্যাদা বা অবহেলার ভেতর থাকেন তার বিষয়ে কোনো ধারণা না রেখেই তিনি গালিগালাজ শুরু করলেন। ভারতের পক্ষ নিয়ে নিজের দেশের লেখকদের এভাবে হেয় করা যায়, এটা বাংলাদেশে বলেই হয়তো সম্ভব। এরপর তার সঙ্গে আলোচনার আসলে যাওয়ার কিছু থাকে না। কিন্তু যেহেতু বার্নিং ইস্যু, ফলে মনে হলো বলা দরকার।

তাসনীম বৃহস্পতিবার (২ মার্চ, ২০২৩) আরেকটা পোস্ট দেন। তাতে তিনি একজন অজ্ঞ মানুষের মতো কিছু বাহ্যি ছড়িয়েছেন। সেগুলো যথাসম্ভব উপেক্ষা করে তাকে রিপ্লাই দেওয়ার চেষ্টা করব।

তাসনীম লিখেছেন, ‘ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগা লোকজনরে নিয়ে কিছু বলার একটা সমস্যা হলো, এরা খুব সহজেই ট্রিগার খাবে এবং আপনার কথা না বুঝেই লাফালাফি শুরু করে দিবে। ইনফেরিয়র হওয়া আর ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগা যে এক জিনিস নয়, এইটা এদের সীমিত রিডিং কম্প্রিহেনশনের বাইরে। সো, আপনি যা বলেন নাই, সেইটা ধরে এরা একটা স্ট্রম্যান ফ্যালাসি করবে এবং নিজের গ্রুপ আর মুরিদানকেও আপনার পিছে লাগিয়ে দিবে।’

আমার বক্তব্য- আমি আগেই লিখেছি যে এই বিতর্ক তাসনীম শুরু করেন নাই। ফলে তার মন্তব্যের জবাবে লেখক মাহবুব মোর্শেদ কিছু লেখেন নাই, লেখার কথাও না। তাসনীম খলিলের বয়স কত আমি জানি না, তবে তার যে ভাষার ব্যবহার তাতে রোগাক্রান্ত বয়স্ক লোক মনে হয়। যারা সবসময়, সব কিছুতে নিজেকে দেখতে পান। মাহবুব মোর্শেদ 'একুশের বইমেলায় কলকাতার বই প্রবেশ' নিয়া আরো যা লিখেছেন তার ধারাবাহিকতায় একটা পোস্ট দিয়েছেন এবং তাসনীম খলিলকে সেই লিংক শেয়ার দিয়েছেন। ফলে তিনি ইনফেরিয়র বলে যে গালিটা দিলেন সেটা তার অভব্যতা।

‘ইনফেরিয়র হওয়া আর ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগা যে এক জিনিস নয়’-এ কথার যে কী মানে দাঁড়ায় খোদা মালুম। এখানে তার মতামত ভারত থেকে যারা পুরস্কার নেয়, ভারতের লেখক আসলে পা টিপে দেয়, বদনা আলগায় দেয়- তাদের মতের সঙ্গে মিলে যায়।’

তাসনীম আরো অনেক কিছু লিখেছেন, সব কিছুর জবাব দেব না। তবে উল্লেখ করে রাখি। তিনি লিখেছেন, ‘ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগাটাকে এরা আধিপত্যবাদ-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী রাজনীতি ইত্যকার অগা-বগা শব্দ ব্যবহার করে মহান করে তুলতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক।’


তাসনীম লিখেছেন, ‘আমি একটা পোস্টে ঢাকার শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশের কলকাতা-ফোবিয়াকে ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স হিসেবে বর্ণনা করেছিলাম। এরা যে আমার পোস্টের মর্মার্থ না বুঝেই ট্রিগার খাবে, বিষয়টা আমি আগেই ধারনা করেছিলাম। হয়েছেও তাই।’

আমার বক্তব্য-‘তাসনীম তার সেই পোস্টে কেন, কাকে ইনফেরিয়র বললেন, এর ব্যাখ্যা দেন নাই। শুধু ইনফেরিয়র বলেছেন। আমি আবার উল্লেখ করছি, কলকাতার সঙ্গে বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে বিরোধ কোনো সামান্য বা নিরাবেগ বিষয় না। তাসনীম খলিলের মতো এত এক্সপোজার পাওয়া একজন ব্যক্তি হুট করে লেখকদের ইনফেরিয়র বলে ফেলবেন আর তার রিঅ্যাকশন হবে না কোথাও, এতটা রোবটিক তো সবাই হয়ে যায় নাই। নিজে কাউকে ... বাচ্চা বলে আবার বলবেন যে আমি দেখলাম তুই ক্ষেপিস কি না, এ ধরনের আচরণ অগ্রহণযোগ্য, বালসুলভ’।

তাসনীম লিখেছেন, ‘আমি কিন্তু কোথাও বলিনি যে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি পশ্চিম বঙ্গের তুলনায় ইনফেরিয়র।’

আমার বক্তব্য-‘লেখকরা ইনফেরিয়র কিন্তু লেখা না, মাথা ঘুরানির অবস্থা! তার মানে তাসনীমের একটা সাহিত্য বিচার আছে। আমি দেখতে চাই সেটা, কোন সাহিত্য ইনফেরিয়র, কোনটা সুপেরিয়র কলকাতার চেয়ে, তাসনীম বলেছেন কোথাও? কারণ একটা হাওয়াই কথা তাসনীম বলে ফেললে তো হবে না। উনি তো সেই তরিকার লোক না। পর্যাপ্ত প্রমাণ, যুক্তি ছাড়া তো উনি কথা বলেন না। তাহলে উনি দেখান কবে কোথায়, কোন সাহিত্য নিয়ে তিনি কী বলেছেন। মন ভোলানোর তো দরকার নাই। নাকি ওনার সরকার ভীতি আছে। সরকারকে বুঝ দিয়ে চলেন তিনি?’

তিনি আরো লিখেছেন, ‘আমি এ রকম মনে করলে বরং চন্দ্রিল ঢাকায় যাবেন শুনলে বিচলিত হতাম, অথবা ঢাকার বইয়ের দোকানে কলকাতার বই বিক্রি নিষিদ্ধ করার দাবী তুলতাম। বলতাম দূর্বলকে সবলের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কলকাতার নাম শুনলেই যাদের লাইড়ে তামাক মলে, আমি তাদের দলে নাই’।

আমার বক্তব্য-‘তাসনীম শুরু থেকেই ইনফেরিয়রিটির গর্তে পড়ে আছেন। আলোচনা মোটেও কলকাতার সাহিত্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সাহিত্যের তুলনা না।বরং এটা সাপ্রেশন বা অ্যাগ্রেশনের আলাপ। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আলাপ। এখানে লেখকদের কিছু করার নাই। তাসনীমের কথা পড়লে মনে হয় লেখকদের বুঝি ক্ষমতা আছে বই আটকানোর।আসলে তো তা নাই। বরং এখানকার লেখকরা রাষ্ট্রের তুলনায় খুব দুর্বল। তাছাড়া তাসনীম যেভাবে ইনফেরিয়রিটিকে কনডেম করছেন তার মধ্যে একটা রেসিজম ফুটে উঠছে।কারণ ইনফেরিয়রিটি মানুষের স্বভাবেরই অংশ। রাষ্ট্র একজন ইনফেরিয়রকে কতটা নার্চার করবে তাসনীমের আলাপ করার কথা সেটা। তিনি উল্টো ইনফেরিয়রিটিকে আঘাত করছেন। এটা তার ভারতপন্থী অবস্থান।’

তিনি আরো লিখেছেন, ‘এখানে বলে রাখা ভালো, কার বই কয়টা বিক্রি হয়, সেই হিসাবে গেলেতো আরিফ আজাদকে আরজ আলী মাতুব্বর থেকে বড়ো দার্শনিক মানতে হবে। অন্য কথায়, ঢাকার নিউ মার্কেটে শওকত ওসমানের বই বেশি বিক্রি হতো নাকি রসময় গুপ্তের বইয়ের কাটতি বেশি ছিলো, সেই হিসাব দিয়ে বাংলাদেশের লেখকদের মান নির্ণয় করাটা স্রেফ মূর্খতা’।

আমার বক্তব্য- ‘আরিফ আজাদ আরজ আলির কাউন্টার ‘দার্শনিক’।আরজ যা আরিফ তার উল্টা।ইসলামের প্রতি যে ক্রিটিক্যাল মেন্টালিটি তাসনীমের, সে জন্য আরজ আলিকে বেটার দার্শনিক মনে হয়। তার এ মন্তব্য স্রেফ একটা বিশ্বাস, এর লজিক নাই। অথচ হিসাব করলে আরিফ আজাদ বেটার।

ঢাকার বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে তাসনীম আদতে একজন কিশোর। এখন হাইপে আছেন দেখে বুঝতে পারছেন না। হয়তো বেটার সাংবাদিক তিনি। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিতে নন।কারণ বই বিক্রি দিয়ে সাহিত্যের বিচার এখানে হয় আবার হয় না, কিন্তু তিনি যে মূর্খ তা বলে একটা নাক সিটকানো ভঙ্গি করেন, সেটা আপত্তিকর। মূর্খতাও সুন্দর হইতে পারে। যেমন সাহিত্য বিষয়ে উনি মূর্খ, তারপরও আমরা লেখকরা ওনাকে ফলো করি এবং গুরুত্ব দিই।’

তিনি এরপর আরো লিখেছেন, ‘কালচারাল প্রডাকশনের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে আমরা দেখি বাংলাদেশের কন্টেন্ট প্রডিউসাররা পশ্চিম বঙ্গের কন্টেন্ট প্রডিউসারদের সাথে সমানে সমান টক্কর দিচ্ছে।

ইউটিউবের মতো ফ্রি মার্কেটে বাংলাদেশের ভিডিও আর পশ্চিমবঙ্গের ভিডিওগুলোর ভিউ মিলিয়ে দেখেন, আমার কথার প্রমাণ পাবেন।

আবার হৈচৈ-এর মতো ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও আশফাক নিপুণের মতো নির্মাতারা বাজার ডমিনেশনের দিকে এগোচ্ছে। অবস্থা এমন যে হৈচৈ এখন টাকার বান্ডিল (নাকি রুপির বান্ডিল) নিয়ে বাংলাদেশী নির্মাতাদের পিছনে ঘুরছে। সম্প্রতি দেখলাম বাংলাদেশী নির্মাতাদের আটটি প্রডাকশন সাইন-আপ হয়েছে এই একটা প্ল্যাটফর্মেই।


এইটার জন্য কিন্তু বাংলাদেশের ভিডিও কন্টেন্ট প্রডিউসাররা সরকারী বা প্রাতিষ্ঠানিক আনূকল্য বা প্রটেকশন কোনটাই পায়নি। তারা নিজেদের যোগ্যতায়, নিজেদের বুদ্ধি ও গতর খাটিয়ে ফ্রি মার্কেটে গেছে এবং প্রডাকশন কোয়ালিটি দিয়ে মার্কেট জয় করেছে।

আমার বক্তব্য- ‘সাহিত্যের আলাপের জন্য এটা জরুরি না। তাসনীম সাহিত্যিক বা লেখকদের হরে-দরে ধরে নিয়ে একটা বাজারি আলাপ পারতে চাইছেন।কিন্তু আমরা খুশি হই ধরে ধরে আলাপ করলে। সাহিত্য আর সিনেমার আলাপ আলাদা করলে। উনি এই সংকটের সমস্ত দায় আমাদের লেখকের ইনফেরিয়রিটিকে দিয়ে এখন নানা গল্প ফাঁদছেন। শুধু হৈচৈ-এ আশফাক নিপুণ কেন, আমাদের সাদাত হোসাইনের বইও তো বিক্রি হচ্ছে ওদের বইমেলায়। কিন্তু কেন হচ্ছে? আমাদের জয়া আহসান,  শাকিব খান কেন যাচ্ছেন কলকাতায়? আশফাক নিপুণের এই অর্জন কি আমাদের অর্জন না বিসর্জন? ঢাকা শহরে এগুলা নিয়েও আলাপ কম হয় নাই।এবং এসব ক্রেডিটের প্রতিদান হিসেবে এখন কলকাতার পাবলিশাররা আমাদের একুশে বইমেলায় ঢুকতে চাইছে, সিনেমা হলে সিনেমা রিলিজ চাইছে। তারা বলছে তোমাদের জন্য এত করছি, তোমরা আমাদের জন্য কী করলে? এই ফাঁদ তাসনীমের মাথায় ধরল না, নাকি তিনি গোপন করলেন, দালালি করলেন? আর তিনি যে বলছেন এই ভিডিও কনটেন্ট নির্মাতারা সরকারি আনুকূল্য পায় নাই এর তথ্য-প্রমাণ কই? নাকি তাসনীম যা বলবেন, সব ছহি বলবেন?উনি বললেন আর সেটাই ঠিক ঠিক হয়ে গেল?’ 

খলিল আরও বলেন, ‘বিপরীতে আমরা বইয়ের প্রডাকশন/পাবলিশিংয়ে কী দেখি? বছরের পর বছর ধরে বাংলা একাডেমীর বইমেলায় পশ্চিমবঙ্গের বাংলা বই নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের পাঠকরা ঠিকই বাতিঘরের মতো দোকান থেকে পশ্চিমবঙ্গের বইগুলোই বেশি কিনছে। এতো বছর প্রটেকশন দিয়েও একাডেমী বাংলাদেশের বইয়ের প্রডাকশনকে কলকাতার লেভেলে নিতে পারেনি। কারণ এহেন প্রটেকশন ভালো বাজার তৈরির পরিবর্তে বাজার নষ্ট করে। এটা আমরা দুনিয়ার অন্যান্য দেশে অন্যান্য প্রোডাক্টের ক্ষেত্রেও দেখেছি। ফ্রি মার্কেট ইকোনমির এটাই নিয়ম।’

আমার বক্তব্য- ‘বেশি কিছু বলার নাই। বাংলাদেশে কলকাতার বই কীভাবে আসে, কারা আনে, সেগুলো আনার পর ডিসপ্লে কীভাবে করা হয়, শেলফ থেকে বাংলাদেশের বই নামিয়ে দিয়ে কলকাতার বই তোলা হয়, কলকাতার বইয়ের এত বাজারই যদি থাকত আজিজ বন্ধ হয়ে গেল কেন? কলকাতার বই কত বিক্রি হয়, বাংলাদেশি লেখকের বই কত বিক্রি হয়, কোনো পরিসংখ্যান না দিয়ে তাসনীম তার গোয়ার্তুমি দিয়ে কথা বলছে। বলুক। কিন্তু আমার আপত্তি হলো সাহিত্য আর ফ্রি-মার্কেট এক জিনিস না, এটা তাকে কেউ বুঝান। উপন্যাস আর ইন্ডিয়ার মধু আলাদা। ওটিটি আর কবিতা আলাদা।’

তাসনীম লিখেছেন, ‘অবশ্য বাংলাদেশের যেসব লেখক ঢাকায় কলকাতার বই নিষিদ্ধ করার দাবী তুলেছেন তারা ফ্রি মার্কেটের বিষয়ে খুব একটা ধারণা রাখেন বলেও মনে হয়না। যেমন মাহবুব মোর্শেদ (উনার বাবা সম্প্রতি মারা গিয়েছেন, তাই তার প্রতি পূর্ণ সমবেদনা রেখেই লিখছি)।

মোর্শেদ সম্প্রতি এই বিষয়ে একটি পোস্ট লিখেছেন এবং সেই পোস্টের লিংক আমার পোস্টের কমেন্টেও দিয়ে গেছেন। আরেকটা কমেন্টে আমার পোস্টকে চিন্তাহীনও বলেছেন। সেই পোস্ট পড়ে আমি ধরেন তিন দিন পাগল আছিলাম।

যেমন পোস্টের প্রথমেই মোর্শেদ ঢাকাই মসলিনের আলাপ দিয়েছেন। সেখানে ঢাকাই মসলিনের উত্থান ও পতন সম্পর্কে তিনি যে আলাপ দিয়েছেন, সেটা ফ্রি মার্কেটের পক্ষে এবং ক্যাপটিভ মার্কেটের বিপক্ষেই যায়। ঢাকাই মসলিনের ইতিহাসে না গিয়ে সংক্ষেপেই বলি, মসলিন একসময় তার কোয়ালিটি দিয়েই বিশ্বব্যাপী ফ্রি মার্কেটের লাক্সারি সেগমেন্টটা দখল করে ছিলো। মসলিনের পতন বরং হয়েছে যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই প্রোডাক্টটাকে ক্যাপটিভ মার্কেটের অধীনস্ত করতে চেয়েছে, করেছে।

আমরাও তো চাই বাংলাদেশের বই ফ্রি মার্কেটে কম্পিট করে ঢাকাই মসলিনের মতো বিশ্বের বাংলা বইয়ের সেগমেন্টটা দখল করুক। চাই বলেই ক্যাপটিভ মার্কেটের বিরোধীতা করি!’

আমার বক্তব্য- ‘এখানে বেশি কিছু বলব না। সাহিত্য আর অন্য মার্কেট আলাদা। আমরা যখন আফ্রিকান উপন্যাস পড়ি তখন আমরা কোনো আফ্রিকান কফি বা চকলেট খাই না।আমরা একটা গোটা জাতিকে চিনতে পারি। এটা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বিষয়। লেখকদের ইনফেরিয়র থেকে সুপেরিয়র হওয়ার বিষয় না। মার্কেটে কম্পিট করার বিষয় না। এটা স্রেফ অনুবাদ করার বিষয়।’

তাসনীম লিখেছেন, ‘অবশ্য মোর্শেদের পোস্টে লাইক, হার্ট, কমেন্ট দেওয়া লোকজন ফ্রি মার্কেটের বেসিকটাও জানেন কিনা সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। তিনি বোকাদের এড্রেস করে পোস্ট লিখেছেন এবং বোকারাই সেটা গ্রহণ করেছে। মোর্শেদের পোস্টে যে একটা নির্জলা অসত্য কথা আছে, সেটাও এরা ধরতে পারেনি।’

আমার বক্তব্য- ‘তাসনীম নিজেকে যেমন চালাক ভাবেন, ওনার লাইক-কমেন্টদাতারাও সমান চালাক ভাবেন। না হলে নিজে আর চালাক থাকেন কীভাবে?ওনার প্রস্তাব হলো চালাকরা শুধু চালাককে লাইক দেবে আর বোকারা লাইক দেবে বোকাদের। কখনো কোনো চালাক বোকাকে লাইক দিতে পারে না, সংবিধানে নাই।’

তিনি লিখেছেন, ‘তার (মাহবুব মোর্শেদ) পোস্ট থেকেই উদ্ধৃতি দেই: "বাংলাদেশের অধিকাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে ভারত যেভাবে এন্টি ডাম্পিং নীতি প্রয়োগ করে বইয়ের ক্ষেত্রেও সেই একই ঘটনা ঘটে। [...] এর পরও যদি বই রপ্তানি করতে হয় তাহলে উচ্চ শুল্ক দিয়ে সেই বই ভারতের বাজারে ঢোকাতে হবে।"

আমিতো ভারতীয় সরকারের বিভিন্ন ওয়েবসাইট খুঁজে বাংলাদেশী বইয়ের উপর এন্টি-ডাম্পিং শুল্ক বলবৎ আছে, এমন কোনও তথ্য পেলাম না। ইন ফ্যাক্ট, একটা সরকার এন্টি-ডাম্পিং শুল্কতো তখনই দেয় যখন একটা ফরেন প্রোডাক্ট তার দেশের লোকাল প্রোডাক্টটের উপর হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ট্রেডিং ডাটা বলছে যে ভারত বাংলাদেশে প্রতি বছর মিলিয়ন ডলারের উপর বই রপ্তানি করে, বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে আমদানী করে দেড় লক্ষ ডলারের মতো। এই অবস্থায় ভারত কেন বাংলাদেশের বইয়ের উপর এন্টি-ডাম্পিং শুল্ক দিবে? ভারতীয় অর্থনীতির নীতি-নির্ধারকরা কি গাঞ্জা খায়?’

আমার বক্তব্য- ‘এন্টি ডাম্পিং বা এসব নিয়ে আমার কিছু বলার নাই। আমি ক্লিয়ার না এটা। কিন্তু তাসনীম কি একবার পরীক্ষা করে দেখছেন বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় বই পাঠাইতে কী হ্যাপা। আমি একটা স্ট্যাটাস এখানে উল্লেখ করি নাহিদ হাসান নলেজের, ‘ডাকঘরের বই ইণ্ডিয়াতে পাঠাতেই পারলাম না। বিএসএফ আটকায়। কুরিয়ারে করোনায় ইণ্ডিয়া থেকে বই আনা গেছে, পাঠানো যায়নি। অন্য সময় পাঠাতে কেজিতে ২৫০ টাকা, আনতে ১৫০ টাকা।

এইসব সমস্যার সমাধান করার কথা কেউ বলে না কেন?’

এ ধরনের ঘটনা আরো আছে। প্রতিনিয়ত কলকাতার বইয়ের আগ্রাসন মোকাবিলা করতে হয় এখানকার লেখক-প্রকাশকদের। সবচেয়ে বড় কথা কিছু বলা যায় না। বলার জায়গাও নাই।

কথা হলো তাসনীম খলিল ওয়েবসাইট ঘাঁটলেন, কিন্তু সরেজমিন পরীক্ষা করলেন না বাস্তবতাটা কী? এটা তার অসততা। তার পুরো বক্তব্য দাঁড়ায়ে আছে ওয়েবসাইটের একটা তথ্যের ওপর।আমাদের ক্ষেত্রে সেটা না। আমরা প্রতিমুহূর্তে দেখতে পাই আমাদের বই দেশের বইয়ের দোকানগুলোয় রাখা হয় না।রাখা হয় কলকাতার বই। এর সঙ্গে অনেক ক্ষমতার নদী-নালাযুক্ত।পাঠক কলকাতার বই কেনে কারণ তাদের সামনে আমাদের বই আসেই না। আমাদের বইয়ের খবর কোনো পত্রিকায় আসে না। কিন্তু কলকাতার ওমুক লেখকের সাক্ষাৎকার যিনি ছাপেন, তার কদর বেড়ে যায়। সব সময় এটাই হয়ে আসছে। তো আমার শেষকথা, তিনি যেহেতু ধরেই নিছেন এরা ইনফেরিয়র, তো তিনি বোধহয় সুইডেন থাকেন।সেখান থেকে ইনফেরিয়রিটি তাড়ানোর ওষুধ চাই ওনার কাছ থেকে।’

তিনি এরপর যা লিখেছেন তা শুধু উল্লেখ করে গেলাম। আমার বক্তব্য এখানেই শেষ।

‘বাজার, ফ্রি মার্কেটের কথা রেখে এখন একটু বাংলাদেশের মার্কেট অফ আইডিয়াস বা বুদ্ধিজীবীতার কথায় আসি।

এক চিত্রশিল্পী দেখলাম আলাপ তুলেছেন আমি (তাসনিম খলিল) একজন প্রবাসী। আমি কেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীতা নিয়ে কথা বলবো?! এই প্রশ্নের উত্তর: আমরা সেটাই বলি যেটা আপনারা বলতে পারেন না। এটাই আপনাদের অবস্থা।

এই বইমেলায় যে বইগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেই সেই পাঁচটা বইয়ের চারটার লেখকইতো প্রবাসী। অথচ এই বইগুলাই কিন্তু এখন বেস্ট সেলার, পাঠকতো এগুলোই পড়তে চাচ্ছে। কেন চাচ্ছে, সেই আলাপে না গিয়ে যদি আপনারা আবাসী লেখকদের বইয়ের বাজার সংরক্ষণের জন্য প্রবাসী লেখকদের বই নিষিদ্ধ করার দাবী তোলেন তাইলেও কিন্তু আমি অবাক হবোনা। ইনফেরিয়রটি কমপ্লেক্সে ভোগা লোকজনের রাজনীতি এটাই। আজকে যারা কলকাতা-ফোবিয়াতে ভুগছে, কালকে তারাই প্রবাসী-ফোবিয়াতে ভুগবে।

অভিজিৎ রায়ের কথা মনে আছেতো? কলকাতার প্রবীর ঘোষের মতো লেখক থেকেও সুপিরিয়র লেখক ছিলেন এই প্রবাসী বাংলাদেশী। আপনাদের বইমেলার বাইরেই তাকে কুপিয়ে মারা হয়েছিলো। ভারতীয়রা মারেনি, বাংলাদেশীরাই মেরেছে।’

 

 
সালাহ উদ্দিন শুভ্র
সালাহ উদ্দিন শুভ্র
প্রকাশিত বই - গল্পগ্রন্থ - মানবসংবিরল, উপন্যাস - গায়ে গায়ে জ্বর। পরিচিতি - লেখক, সমালোচক

সর্বশেষ

নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা

জনপ্রিয়

মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
নীতুর লিপস্টিক
নীতুর লিপস্টিক