বাংলাদেশ
পরীক্ষামূলক প্রচার
01-Jul-2024
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
সালাহ উদ্দিন শুভ্র
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম

আমরা প্রায় সবাই জানি যে কাকের বাসায় কোকিল ডিম পাড়তে আসে। সেই ডিমে কাক তা দেয় এবং তা ফুটে একটা কোকিল বের হয়ে আসে। দেখতে একইরকম- এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে কোকিল তার বংশবিস্তার বজায় রাখে। কোকিল জানে না যে পুঁজিবাদেরও এমন স্বভাব। অন্যের বাসায় অন্যের মতো হয়ে সে ডিম পারবে। জহুরি না হলে তা টের করা যায় না। যেমন এই ভালোবাসা দিবস। এই দিবসটিও ধর্মীয় উৎসবের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। এখন যদিও তা বুঝা যাবে না। কারণ এর উপর অনেক মেকআপ পড়েছে। ‘আধুনিকমনারা’ কেউ হয়ত মানতে চাইবেন না যে ভালোবাসা বা নারী-পুরুষের যে প্রেমের সম্পর্ক, তাও ধর্মীয়। এখন এর ‘সেক্যুলার’ অনেক ভাবভঙ্গি পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু মানবেতিহাসের আদিতে তা ধর্মীয়ই ছিল। এখনো আছে স্বীকারের অপেক্ষা ছাড়াই।

এখনো তো আমরা এমনটা দেখি যে, প্রেমে সফল হওয়ার জন্য নানা ফন্দিফিকির করতে হয়। নানা বুদ্ধি খাটাতে হয়। কেউ কেউ মানত করেন, তাবিজতাগা পরেন  ও পরান। হাল আমলের আধুনিকরা নান কূটনীতি করেন। অথবা তাদের দাবি থাকে যে তার পছন্দের উপর কেন অন্যে হস্তক্ষেপ করবে? কিন্তু একটু ভাবলেই বুঝা যাবে যে, ভালোবাসা সামাজিক, পারিবারিক একটা বিষয়। এবং এর সঙ্গে অনিবার্যভাবে একটা মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষা জড়িত। একে অন্যের প্রতি কমিটমেন্টের বিষয় আছে, পরস্পরের প্রতি ভালো চাওয়া আছে। তো এই যে চাওয়া বা প্রত্যাশা বা কামনা এগুলো কোত্থেকে আসবে। এগুলো নিশ্চিত করার জন্য অর্থকড়ির আলাপ তুললে তাতে ভালোবাসা খাটো হয়। কারণ ভালোবাসা বলতে যে প্রেমকে আমরা বুঝি তা নফসের কাজ বা দিলের কাজ। দিলের প্রতিক্রিয়া। একে কোনো বস্তু, উপহার, কোন শর্ত ইতাদিতে সীমাবদ্ধ করা যায় না। হ্যাঁ আধুনিকেরা ভালোবাসতে গেলে এসব কাজে লাগান। তবে এগুলো সবই তার মনস্কামনার মূর্ত প্রকাশ।

যখন এসব ‘উপহার’ কিনে দেওয়ার ব্যাপার ছিল না তখন কী ঘটত। ভালোবাসা দিবসের আদি ইতিহাসেই আছে- প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যে মধ্য ফেব্রুয়ারি যা ১৫ বলে তারা ধরে নিত, সেদিন উর্বরতা, অর্থাৎ সন্তানবতি হওয়ার প্রার্থণা করা হতো। এদিন তারা কুকুর ও ছাগল বলি দিত। কুমারি মেয়েরা সেই কুকুর বা ছাগলের চামড়ার স্পর্শ নিত যাজকদের কাছ থেকে। তরুণরাও তাই করত। এই উৎসবের বিভিন্ন বিবর্তন হয়েছে। এর সময়কাল ধরে নেওয়া হয়, খ্রীস্টাব্দ পাঁচ শতক। ইসলাম এসেছে আরো পরে। প্রটেস্ট্যান্টদের আগমন ঘটেনি। যে ভ্যালেন্টাইনের কথা বলা হয় প্রেমের জন্য জীবন দিয়েছেন, তিনিও সেই ধর্ম রক্ষা, অর্থাৎ শাসকের যুদ্ধ পরিচালনার জন্য জারি করা বিয়ে বন্ধের আদেশের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন।

পৃথিবীজুড়ে ভালোবাসার যত কাহিনী সেগুলোও শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভালোবাসা বা প্রেমকে টিকিয়ে রাখা স্রষ্টার পক্ষের কাজ হিসেবে দেখানো হয়েছে। সে হোমার ইলিয়াড হোক কি পদ্মাবতী হোক। ন্যায়, সততা, বিশ্বাস ও স্রষ্টার কাছে নত হয়া ছাড়া প্রেমে সাফল্য নাই। মহাকাব্যিক যুগ এখন নাই যদিও, ভুবন মাত করে দেওয়া ভালোবাসাও আর দেখা যায় না, কিন্তু আমরা সেসব প্রেমেরই উত্তরাধিকার। 

ভালো বাসার মতো ভালো একটা কাজের মধ্যে পুঁজিবাদ ঢুকে পড়েছে বটে, তবে তাতে ভালোবাসার দোষ নাই। খালি খেয়াল রাখতে হবে পুঁজিবাদের চালাকিগুলোর দিকে। সে যেন আমাদের ভালো বাসায় এসে ডিম না পেড়ে যেতে পারে। কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, পুঁজিবাদের কাজই হলো এই যে সে তার জন্য যা উপযুক্ত তাকে প্রমোট করবে আর যা তার বিরুদ্ধে যাবে তাকে ধামাচাপা দেবে। ভালোবাসা ব্যাপারটার মধ্যে সরাসরি রাজনৈতিক কর্মসূচি যেহেতু থাকে না ফলে তা পুঁজির জন্য সুবিধাজনক। আরেকটি ব্যাপার হলো মানুষের মনোজগতে অন্যকে জয় করার বিভিন্নরকম চিন্তা ঘুরে বেড়ায়। সোজা হাতে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকেতে চায়। যেহেতু প্রেমের ব্যাপার সেহেতু আঙ্গুল সোজা রাখার কৌশলেই সবাই থাকতে চায়। যে জন্য উপহার মোক্ষম দাওয়াই।মানষের মন উপহার পছন্দ করে।

পুঁজিবাদ এগুলো সহজেই ধরতে পারে। সে বুঝে যায় কোথায় বিনিয়োগে তার লাভ সবচেয়ে বেশি। ভালোবাসা দিবসে তাই সে পশ্চিমের দেশে দেশে পোশাক, খাবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন গিফট আইটেম বাজারে নিয়ে আসে। অন্য সময়ের তুলনায় এদিন সগুলোর দাম বেশি। আর দামের চিন্তা করে ভালোবাসার এক্সপ্রেশনেকে রোখা যায় না। ফলে দামি পোশাকটা, গ্যাজেটটা, রেস্টুরেন্টের মেনুটা খেয়ে ফেলতে হয়। ভালোবাসাও এতে অটুট থাকল আর পুঁজিরও লাভ হলো। উচ্ছিষ্ট যা থাকলে তা বিক্রির জন্য থার্ড ওয়ার্ল্ড তো বাকি আছেই।

পুঁজিবাদের এক নবির নাম ম্যাক্স ওয়েবার। তিনি একে সাস্টেইন করার নানা উপায় বাৎলে দিয়েছেন। সেই পথে পুঁজিবাদ হাঁটছে ভালোই। সম্পর্ক ভাংছে আবার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, এই যে সামাজিক পরিস্থিতি বর্তমানে, এ নিয়ে মোর‍্যাল সংকট অস্থিরতা সব সইয়ে দিচ্ছে পুঁজিবাদ। কারণ সম্পর্ক ভাঙ্গতেই পারে, আবার সে নতুন কোথাও যুক্ত হতে পারে। ধর্মেও এসব বিষয়ে নিষেধ নেই। তবে জুলুম বা জবরদস্তিতে, প্রতারণায় নিষেধ আছে। পুঁজিবাদও এসবে প্রশ্রয় দেয় না। পুঁজিবাদ যা করেছে তা হলো ভালোবাসাকে ধর্ম থেকে আলাদা করে ফেলছে।

এতে অবশ্য একটা ক্ষতি হয়েছে। কাব্যের ক্ষতি। ভালোবাসা নিয়ে আর তাই তেমন কাব্য জমছে না। সাহিত্য হচ্ছে না, দর্শন হচ্ছে না। পজিটিভ পরিবর্তনের আশা জাগছে না। যার যার সম্পর্ক তার তার হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক, পারিবারিক বন্ধন হালকা হচ্ছে। কোন কোন ব্যক্তি প্রচণ্ড একা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতার মানসিকতা বাড়ছে। এতে বিদ্বেষও বাড়ছে। যারা ভালোবাসাবাসি করছেন খুব তাদের বুঝতে হবে পুঁজিবাদের মধ্যে থেকেই পুঁজিবাদকে ট্যাকল করার কৌশল। পুঁজিবাদকে না ঠকাতে পারি কিন্তু লাইনে তো তাকে আমরাও রাখতে পারি। শুধু আমার মনের অবচেতন ঘরে তার আনাগোনা বন্ধ করে দিতে পারলেই কিন্তু হয়। 

সালাহ উদ্দিন শুভ্র
সালাহ উদ্দিন শুভ্র
প্রকাশিত বই - গল্পগ্রন্থ - মানবসংবিরল, উপন্যাস - গায়ে গায়ে জ্বর। পরিচিতি - লেখক, সমালোচক

সর্বশেষ

নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা

জনপ্রিয়

মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
নীতুর লিপস্টিক
নীতুর লিপস্টিক