কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
নতুন বছরের ডামাডোলের ভেতর বারংবার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে নগদ টাকা তুলে চোখে ঝাপসা দেখছিলাম। পানি খুঁজতে গিয়ে আবার মিজানুর রহমান গাজীর সঙ্গে দেখা। গাজী কাকা। চাঁদপুরের অধিবাসী। বর্তমানে রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় দ্বিতীয় স্ত্রীসহ ভাসমান। প্রথম স্ত্রী-সন্তানেরা চট্টগ্রাম। কিন্তু, এখন ওনার কাছে পানি নাই। আগে অবশ্য উনি পানি বিক্রি করতেন।
আর ওনার সঙ্গে থাকতেন শামীমা আন্টি; মানে গাজীর দ্বিতীয় স্ত্রী। তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল সচিবালয়ের সামনে। পরিচয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই কোর্টে গিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে। ২০২০ সালের শুরুর দিকে স্বাধীনতা উদ্যানের এক নম্বর রাস্তা ঘেঁষে শুরু করেন যৌথ জীবন, নতুন সংসার।
আন্টি গোপালগঞ্জের মেয়ে। বর্তমানে সেখানে গেছেন ধান লাগাতে। কাকাকেও সঙ্গে চেয়েছিলেন। তিনি টাকা নেই ‘এইটা ওইটা ধানাইপানাই’ করে থেকে গেছেন। এনআইডিতে ‘পাঁচ পঞ্চাশ’ আর বাস্তবে ৫৭ বছর বয়সী গাজী বলছিলেন, পানির ব্যবসায় ‘ধরা খাওয়ার’ কথা।
বোতল নিয়া হাইটা যায় গা; বলে পরে দেবে, আর দেয় না।
ইদানিং প্লাস্টিকের ব্যবসায় নামার ব্যাপারে ভাবছেন। নিমতলীতে দোকান নেবেন এমন পরিকল্পনা আছে। আবার বললেন, বইমেলার কথাও। সেখানে চা-সিগারেটের দোকান দেওয়ার কথাও মাথায় নিয়েছেন।
ওনার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে পানির দোকান খুঁজতে খুঁজতে কথা হলো। আগে উনাকে আমি পার্কের বাইরে সাভার-বিশমাইল-নবীনগর বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে দেখেছি। কখনও একা, কখনও আন্টির সঙ্গে।
একবার বিশমাইল গেটে দেখা বললেন, জাহাঙ্গীরনগরে তার এক ক্যান্ডিডেট ওয়েটিংয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করলেন, কবে নাগাদ ভর্তি শুরু হতে পারে; আমি কিছু জানি কী না ?
পরে জানলাম ওই দিকে আন্টির আগেরপক্ষের মেয়ের বাসা। তার কাছেই তাদের নতুন বিয়ের কাগজপত্র জমা আছে। রাস্তায় থাকলে কলহ লেগেই থাকে। তার ওপর তাদের বিশেষায়িত সংসার তাই প্রচুর ঝগড়া। আন্টি ঝগড়া করে; বাস ধরে চলে যান সাভার, মেয়ের বাসায়। গাজী আবার তাকে ফেরত আনতে সাভার যায়।
তাদের এ রকম যাতায়াতের ভেতর আমি বারবার পড়ে যাচ্ছিলাম। কারণ, আউটস্কার্টে থেকে মেট্রোর জীবনকে ধাওয়া করে দেখছিলাম।
সে যাই হোক, গাজীর মতোন এক গ্যাস কোম্পানির চাকরি হারিয়ে রাস্তার জীবন বেছে নেওয়া একজনকে প্রাথমিক আলাপের পর একপর্যায়ে স্বপ্ন পূরণের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে হবে ভেবে খানিক বিব্রত হয়ে জানতে চাইলাম,
প্ল্যানটা কী তাইলে সামনে?
তখন তিনি বললেন, স্বপ্নের কথা আর কী বলব? চাঁদপুরে একটা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা তিনি নিজে, তার ছেলে-মেয়ে (আগের পক্ষের তিন মেয়ে এক ছেলে) যেন সুশিক্ষা পায়, তাই চাওয়া। যদিও মাসে-দুই মাসেও চট্টগ্রামে ‘আগেরপক্ষে’র স্ত্রী-সন্তানদের দেখতে যান না। কিন্তু, ঠিকই স্বপ্ন দেখেন নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে ডাক্তার বানাবেন। ছেলেটা চতুর্থ শ্রেণিতে। সব ছোট এক মেয়ে।
আরও বললেন, তিনি নিজে আওয়ামী লীগ করেন। এটাই তার সমস্যা। ২০০৮ সালের পর থেকে নানান জটিলতায় ভোটটাই দিতে পারেননি বলে অস্পষ্ট আক্ষেপও করলেন। তাকে খানিকটা পলিটিক্যাল হয়ে উঠতে দেখে, প্রশ্ন ছুঁড়লাম,
মন্ত্রীরা কী করে আসলে আমাদের দেশে, আপনার কী কোনো ধারণা আছে?
মনে হলো প্রশ্নটার জন্যেই বসেছিলেন গাজী; লুফে নিয়ে জানালেন, এক প্রভাবশালী নারী মন্ত্রীর হয়ে নির্বাচন করেছেন। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে কাজ করেছিলেন। কিন্তু, এবার তার ‘আগেরপক্ষে’র মেয়ে যখন চট্টগ্রামের ‘চৌধুরীস্কুলে’ সুযোগের আবদার করল তখন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে শুনেছেন, ‘তদবির চলে না’।
অথচ, চট্টগ্রামে গ্যাস কোম্পানি ঠিকাদারের অধীনে কাজ করার সময় তিনি অনেকবার ‘পারমিশন করানো’র কাজে পার্লামেন্টে গেছেন। সেখানে লেনদেন হয়েছে, কাজও হয়েছে। কিন্তু, এ দফা নিজের মেয়ের কাজটাই হলো না।
আলাপের এক পর্যায়ে তিনি আবাসিক গ্যাস সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে বললেন,
সবই ডান হাত-বাম হাতের খেলা; কাকা। কিন্তু এখন ‘কাউয়া বেশি শিন্নি কম’।
এর মধ্যেই আমি আলাপ থেকে খানিকটা বিচ্যুত হলাম; জোড়া এসএমএস-এ ফোন কেঁপে উঠল। একটা সমাজসেবা দিবসের সরকারি বাল্ক মেসেজ আরেকটা ব্যাংকিং পার্টনারদের ইসলামিক সেবা দেওয়ার অঙ্গীকার। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে গাজীকে চালিত করতে চাইলাম, তার ভেতরেও বিরাট অস্থিরতা।
এই বলছেন, ঢাকায় প্লাস্টিকের ব্যবসায় করবেন। আবার বলছেন, সাভারের সুপ্রিম জুট মিলে গ্যাস লাইনের কাজের বিল আটকে আছে; সেটা উদ্ধার করবেন। আমি জানতে চাইলাম,
রাস্তায় থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দিনে সর্বোচ্চ কত টাকা রোজগার করেছেন?
মিজান গাজী জানালেন, চার হাজার পাঁচশ টাকা।
আমি কথার খেই নিজের হাতে রেখেই বললাম,
একদিনে আসলে কত টাকা হলে ভালোভাবে চলা যায়; বলেন তো?
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে চরমোনাই পীরের জাতীয় সরকার-ধোঁয়াতোলা বিরিয়ানি পেয়েছিলেন দুপুরের খাবারে। সে কারণেই কি না গাজী বললেন,
কারও কাছে কিছু আশা করি না।
আরও খানিকটা ভাবের দিকে নুয়ে বলে চললেন,
ফজরের আজানের সময় উঠে থেকে কাজ শুরু করেন। কাজ বলতে দর্শনার্থীদের ফেলে যাওয়া পানির বোতল সংগ্রহ। কেনাবেচা দুইটাই চলে। দিনে হাজার টাকাও থাকে আবার দুইশ’ টাকাও থাকে। এক এক দিন এক এক রকম।
টাকার অঙ্কের সঙ্গে ওঠানামা করে তাদের দাম্পত্যের হাল। টাকা না থাকলেই কলহে জড়ান। আর আন্টি বাসে উঠে সাভারসহ নানান গন্তব্যে চলে যান।