বাংলাদেশ
পরীক্ষামূলক প্রচার
01-Jul-2024
নীতুর লিপস্টিক
উম্মে রায়হানা
নীতুর লিপস্টিক

নীতু একটা লিপস্টিক পেয়েছে। গিফট। বিদেশ থেকে আসা লিপস্টিক। ব্র্যান্ডের নাম রেভ্লন।লাল রঙের এই লিপস্টিক ঠোঁটে মেখে নীতু তার আপাতত সিঙ্গেল জীবনের জন্য একটু দুঃখবোধ করে। সেই দুঃখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কারণ একবার বাথরুমের আয়নার সামনে লিপস্টিকটা ঠোঁটে মাখার পর, ঘরে এসে এই লিপস্টিকের উপযোগী পোশাক নির্বাচন করতে গিয়ে জানালার কাঁচের দিকে তার চোখ পড়ে, সেই কাঁচে নিজের ছায়াকে সে চিনতে পারে না। সারা দিন চিনতে পারা না পারা খেলার প্রস্তুতি নিয়ে নীতু ঘর থেকে বের হয়।


ড্রয়িং রুমে তার বড় ভাই, ‘বড়ভাই’ যে বাবার মত, বাবার দায়িত্ব পালন করে সে যে প্রায় ‘বাবা’ই হয়ে গেছে (এ কথা নীতু আর তার ‘প্রায় বাবা’ বড় ভাই অনেকবার শুনেছে) – সোফায় কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। প্রতি শুক্রবারেই তাকে এমনভাবে টিভির রিমোট হাতে সোফায় শুয়ে ঘুমাতে দেখা যায়। হয় সে রাতে ঘুমায় না কিংবা টিভির শব্দ ছাড়া বৃহস্পতিবার রাতগুলোতে তার ঘুম আসে না। নীতু কখনও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করেনি।


সে দরজা খোলে একটু সাবধানে, ভেতর থেকে লক করে টেনে দেয় যথাসম্ভব নিঃশব্দে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তার চোখে টিভি স্ক্রিনটা ভেসে থাকে, যেখানে no or bad signal লেখা উঠেছিল ‘টম অ্যান্ড জেরি’ কার্টুনের উপরে। ভাইয়া কার্টুন নেটওয়ার্ক দেখে তা তার জানা ছিল না। নারীসঙ্গ বিবর্জিত, অন্তত আপাতদৃষ্টিতে, বত্রিশ বছরের একজন যুবক কার্টুন নেটওয়ার্ক দেখে দেখে বৃহস্পতিবার রাতগুলোতে ঘুমায়, ভেবে একটু হাসিও পেল নীতুর। যদিও নিজের ভাই, যে কিনা আবার বাবার মতো, তার ক্ষেত্রে এমন হাসিটা হয়তো অন্যায়।

কিন্তু নীতু হাসিটা চাপতে পারে না। আর আজকে তো নীতু নীতু না, অন্য আরেকজন, ফলে সমস্যা নাই।
নীতু সব পরিচিত জায়গায় যাবে বলে ঠিক করে।

শুক্রবার সকালে কোথায় কোথায় যাওয়া যায় ভাবতে ভাবতেই নীতু হাঁটতে থাকে। সে একঘণ্টা হাঁটে , এক ঘণ্টায় সে ঝিকাতলা থেকে শাহবাগে পৌঁছায়।

দুপুর বারটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত সে ইউনিভার্সিটি এলাকার বিভিন্ন চায়ের দোকানে বসে চা খায়।কিন্তু শুক্রবার বলে পরিচিত কারো সাথে দেখা হয় না। এমন কি চায়ের দোকানগুলোও সব অপরিচিত, অ-জায়গায় পায় সে।

প্রত্যেকটা দোকানেই কোন না কোন পরিবর্তন টের পায় নীতু। চায়ের কাপে না দোকানের পিচ্চিগুলোতে- বুঝতে পারে না। প্রতিবার চা খাওয়ার পর সে সাবধানে আয়না বের করে ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক বুলায়।ফলে মিষ্টি মতো ক্রিমসন রেড রঙটা ক্রমশই টকটকে লাল হয়ে ওঠে।

নীতু, তাকে সবাই চিনতে পারছে কি পারছে না- এই পরীক্ষাটা করার জন্য মরীয়া হয়ে উঠে এক সময় T.S.C.র ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করে। সে আশা করে তাকে অপরিচিত লাগবে, গেটের যে পরিচিত চেহারার মামারা থাকেন তারা তাকে আটকাবেন। সে মজা নিয়ে চলে আসবে। কিন্তু লাল লিপস্টিক এর পুরো রহস্য তার জানা ছিল না।

হয়তো এতে কোন রহস্য নাইও। এটাই হয়তো স্বাভাবিক – নীতুকে যারা যারা চিনতে পারে না, নীতুও তাদের চিনতে পারে না। যেমন – নীতুর বাসার সামনেই একটা সুপারশপের, একজন বসে থাকা, অপরিবর্তিত চেহারার সিকিউরিটি গার্ড, ক্যম্পাসের চায়ের দোকানের শিশুশ্রমিকেরা এবং T.S.C.র মামারা। ফলে, নীতু পরিচিত মামাকে অপরিচিত লাগায় একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রয়োজনীয় ঝগড়া বাধিয়ে বসে। মেজাজ খারাপ করে বের হয়ে আসে।

ভুলে যায় যে সে ওখানে ঢোকার জন্য না, বের হয়ে আসার জন্যই গিয়েছিলো। T.S.C. তে ঢোকার তার আদৌ কোন দরকারই ছিল না।

সে অতঃপর সহরাওয়ারদি উদ্যানে ঢুকে পড়ে যেখানে প্রচুর অপরিচিত মানুষ আর গাছপালা তার দিকে পরিচিত ভঙ্গিতে তাকায়। সে অদ্ভুত একরকম আরাম পায়। লিপস্টিকের রহস্য আর একটু ঘনীভূত হয়ে অনুভূতি দেয়।

স্বাভাবিক অবস্থায় অর্থাৎ লিপস্টিক ছাড়া অবস্থায় এই মানুষগুলো আর গাছগুলো মোটেও পরিচিত লাগত না।একা একা এরকমভাবে ভরদুপুর বেলায় সে সরওয়ারদী উদ্যানে ঢুকতও না অবশ্য। এই অস্বাভাবিক অবস্থাতাকে তার কাঙ্ক্ষিত ‘মজা’ দেয়। সে পার্কের ভেতর ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। এমন অনেক কিছু দেখে যা তার কাছে নতুন লাগার কথা কিন্তু লাগে না। এ সময় কেউ তার নাম ধরে ডাকে। বেশ উচ্চস্বরে –‘নীতু, এই নীতু’।
নীতু অবাক হয়ে তাকায়। জিয়া নামের এই ছেলেটাকে সে চিনতে পারে।

এই ছেলেটা সম্পর্কে যা যা সে জানতো সবই মনে পড়ে যায়- ও Anthropology তে পড়ে ,সূর্যসেন হলে থাকে, কবিতা লেখে আর গাঁজা খায়।

‘এখানে কী করেন একা একা’? মজা পাওয়া ভঙ্গিতে জিয়া জিজ্ঞেস করে।

‘এমনেই, ঘুরতেছি। আপনি কী করেন’?

‘কী আর করমু, গাঞ্জা খাই। আচ্ছা ভালো কথা, আপনেরে যে একটা বই পড়তে বলসিলাম, পড়ছিলেন’?

‘না, পড়া হয় নাই। হঠাৎ ঐ বই এর কথা’?

‘আপনের সাথে ঐ বইটা পড়ার পরে আর দেখা হয় নাই। আমি তো আপনেরে ফোন কইরা বলছিলাম পড়তে।ঢাকার বাইরে ছিলাম তখন।পড়লেন না ক্যান’ ?

‘এমনেই, ইচ্ছা করে নাই – চা খাবেন’ ?

‘না’ শক্ত গলা জিয়ার।

‘কেন? রাগ করছেন?’

‘হ্যাঁ’

‘চলেন, চা খাইতে খাইতে মজার একটা জিনিস বলব’

‘কী জিনিস? গল্প?’

‘ধরেন গল্পই, চলেন না’ – নীতু আদুরে গলায় ডাকে।

জিয়া তার দূরে গোল হয়ে বসে থাকা বন্ধুদের কিছু একটা ইশারা করে নীতুর সাথে আগায়- তারা একজন ভ্রাম্যমাণ চাওয়ালার কাছ থেকে অদ্ভুত বাজে গন্ধওয়ালা চা নেয়। নীতু ঘাসের উপর স্যান্ডেল বিছিয়ে বসে পড়ে।

জিয়াকেও তাই বসতেই হয়। নীতু চা শেষ করার পরও ঘাস থেকে ওঠে না। গভীর চোখে জিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।জিয়াও অনেকক্ষণ নীতুর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তারপর বলে- ‘কি জানি একটা মজার জিনিস বলবেন বলছিলেন’?


নীতু চোখ না সরিয়ে বলে – ‘জানেন, আজকে না কেউ আমাকে চিনতে পারে নাই। আপনি শুধু পারলেন’।
‘চিনতে পারে নাই মানে ‘? জিয়া যেন বিরক্ত।


‘আপনি বুঝতেছেন না, আমি ঠোঁটে লিপস্টিক দিছি তো, তাই কেউ এখন আমাকে চিনে না।আমি যদি সারাদিন সারারাত আপনার সাথে থাকি তাইলেও কিছুহবে না। নিখোঁজ সংবাদ ছাপাইলেও না- লিপস্টিকটাতো আমার সাথেই আছে।মনে করেন, একবার টিভিতে অ্যাড দিল না, জয়া আহসান নিখোঁজ হইছে, আমার ভাই যদি এ রকমএকটা অ্যাড দেয় –-

জিয়া নীতুকে থামিয়ে দেয়-
‘আরে তাইতো, আপনে দেখি খুনখারাবি কইরা ফালাইছে, এই কালারের লিপস্টিক কই পাইলেন? বেদম কালার’।

‘পাইছি! আপনি এতক্ষণ দেখেন নাই’?

‘নাতো’

‘ও, এই জন্যেই তো আপনি আমাকে চিনছেন, আমিও আপনারে চিনতে পারছি –

‘বাল চিনছেন, একটা বই পড়তে বললাম মোবাইলে পয়সা খরচ কইরা, পড়লেন না-
‘আজকেই পড়ব’

‘আপনে আর পড়সেন’ জিয়া উঠে দাঁড়ায় ‘লেখকের নামই ভুইলা গেছেন’

‘ভুলি নাই’ নীতু উচ্চস্বরে বলে।

‘বলেন তো, বই এর নামও বলবেন’

নীতু বলে।

জিয়া হাসে, নীতুও হাসে।

উম্মে রায়হানা
উম্মে রায়হানা
জন্ম- ১৯৮৪ ময়মনসিংহ শহরে। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ এ স্নাতকোত্তর এবং জার্নালিজম, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন নিয়ে পরবর্তী মাস্টার্স। আগ্রহের জায়গা - মিডিয়া, ফেমিনিজমস, ফিল্ম, কবিতা, সমাজ আর সময়। পেশা- সাংবাদিকতা এবং গবেষণা। এক সন্তানের জননী, বিবাহ বিচ্ছিন্ন একলা মানুষ।

সর্বশেষ

নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা

জনপ্রিয়

মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
নীতুর লিপস্টিক
নীতুর লিপস্টিক