বাংলাদেশ
পরীক্ষামূলক প্রচার
28-Sep-2024
নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
উম্মে রায়হানা
নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
প্রিয় ফাহমিদা জামান ফ্লোরা,

আশা করি ভালো আছেন। সম্প্রতি আপনার একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দেখতে পেলাম। একটি টিভি চ্যানেলে ‘আমার কিছু বলার আছে’ নামের একটি অনুষ্ঠানে আপনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। অনুষ্ঠানের ভিডিও লিংক অনলাইনে পাওয়া যায়, আমি দেখেছি ফেসবুকে, আপনারই পেইজে। আপনার সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে, একাধিক বার দেখাও হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এই কথাগুলো আমি আপনাকে ব্যক্তিগত পরিসরে, মেসেঞ্জারে বা ফোন করে কেন বললাম না! কেন পাবলিকলি লিখছি! লিখছি কারণ এই অনুষ্ঠানের ক্লিপিং দেখে আমার মনে হয়েছে, আমারও কিছু বলার আছে। কথাগুলো শুধু আপনাকে নয়, আরও অনেককেই শুনিয়ে বলা প্রয়োজন।

এক এক করে বলি।

পুরুষদের নিয়ে আপনার অতি সরলীকৃত ধারণার সঙ্গে আমি একমত নই। পুরুষের নারীর প্রতি বিদ্বেষ, ব্যাটাগিরি, নিয়ন্ত্রণ-প্রবণতা, নিপীড়ন, অসম্মান, নির্যাতন সহ সকল প্রকার টক্সিক আচরণের জন্য অর্ধেক দায়ী পুরুষতান্ত্রিক পদ্ধতি এবং বাকি অর্ধেক সেই ব্যক্তি পুরুষ নিজে। ধনসম্পত্তি বা ক্ষমতা জোরে পুরুষ মহানুভব হয় না, কোনকালে হয়নি। বরং উল্টোটা অনেক বেশি সত্য। টাকা ও ক্ষমতার জোরে নারীলিপ্সু হয়ে গিয়ে রাজাসন ও রাজত্ব হারানোর নজির একমাত্র নবাব সিরাজুদ্দৌলা নন, আরও অনেক রাজপুরুষই রেখেছেন আমি নিশ্চিত। অতীতকালে অর্থবান পুরুষেরা যৌনদাসীদের জন্য হেরেম বানাতো, ধর্মের দেওয়া ক্ষমতায় পুরোহিতরা নারীদের সেবাদাসী বানাতো। ফলে টাকা ও ক্ষমতা না থাকলে হতাশায় পুরুষ নারীকে নিপীড়ন করে এ কথা শুধু ভুলই নয়, রীতিমতো হাস্যকর।

আপনার বক্তব্য হাস্যকর মনে হলেও এ বিষয়ে তর্ক করতে যাইনি কারণ এটা আপনার ব্যক্তিগত মতামত। এ দেশে এখনও অনেক মানুষ আছে যারা মনে করে মেয়েরা গুছানো স্বভাবের হয়, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়, ছেলেরা হয় অগোছালো, এলোমেলো, নোংরা। মেয়েরা রান্না পারে, ছেলেরা পারে না- এমন নানা হাবিজাবি। এই বিষয়গুলো যে সামাজিকভাবে নির্মিত- সেই ধারণাই তাদের নেই। এদের প্রত্যেককে তো আমি ধরে ধরে সেক্সুয়াল ডিভিশন অফ লেবার বা জেন্ডার বা ফেমিনিজম বোঝাতে যাবো না। এই একই কারণে আপনাকেও এ বিষয়ে কিছু বোঝাতে যাইনি।

আপনার গায়ে হলুদের পোশাকে সিগারেট ও ওয়াইনের বোতলসমেত ছবি আমিও দেখেছি। ভাইরাল হওয়ার কারণে নয়, ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে আমরা কানেকটেড। আপনি বৈবাহিক জীবনে প্রবেশ করেছেন, অনেক শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা জানবেন। আপনাকে দেখে আনন্দ হয়েছে, রেড ওয়াইন শুধু উপাদেয়ই নয়, স্বাস্থ্যের জন্য উপকারীও বটে। জানেন নিশ্চয়ই, পশ্চিমের দেশে গর্ভবতী মহিলাদের সীমিত পরিমাণে ওয়াইন পান করতে দেওয়া হয়। এ কথা বললে এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ হয় আঁতকে উঠবে, নয়তো অবিশ্বাস করবে। কেননা আমাদের মধ্যে মদ্যপান নিয়ে সংস্কার ও ভীতি কাজ করে। অথচ এই দেশেই পাহাড়ে জঙ্গলে এমন অনেক নৃগোষ্ঠীর মানুষ আছে যাদের মধ্যে নারী পুরুষ নির্বিশেষে এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে শিশুরাও মদ্যপান করে। কিন্তু তারা তথাকথিত মূলধারার মানুষ নয় বলে আমরা তা জানতে বা দেখতে পারি না। হলিউডের সিনেমায় দেখেছেন নিশ্চয়ই, বিয়ের অনুষ্ঠানে শ্যাম্পেন ওয়াইন ইত্যাদি পরিবেশন করা হয়। আপনি যদি বাংলাদেশে বিয়ে না করে ইউরোপ আমেরিকায় গিয়ে বিয়ে করতেন, তাহলে বিয়ের দিন মদ্যপান ও ধূমপান শুধু নয়, সদ্য পরিণীত বরকে প্রকাশ্যে চুমুও খেতে পারতেন, সেই চুম্বনের ছবিও তোলা হতো। তাতে কেউ কোন দোষ ধরতো না। বরং চুমু না খেলেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা অসম্পূর্ণ রয়ে যেতো। সুতরাং পুরো বিষয়টিকে কালচারাল ডাইমেনশন হিসেবে দেখাই উত্তম।

আমি বলছি না আপনার পয়েন্ট ভ্যালিড নয়। আপনি বলেছেন চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত নমস্য পুরুষ ব্যক্তিত্বদের সিগারেট বা চুরুট হাতে ছবি আছে। অথচ কোন নারী রাজনীতিবিদ বা সেলিব্রিটির ক্ষেত্রে এমন ছবি প্রকাশ হলে তার কেরিয়ারে ধস নেমে যাবে। অতি সত্য কথা, এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড সমাজে আছে। আবার চেয়ে দেখুন প্রচুর চাকমা ও গাড়ো নারীর ধূমপানের ছবি কিন্তু আপনি চাইলেই খুঁজে পাবেন। তখন আর জেন্ডার নয়, বিষয়টা হয়ে ওঠে সোশ্যাল ক্লাসের। বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত নারীর জন্য নির্ধারিত মানসম্মানের আইডিয়া আর কাজ করে না!

আপনার মনে আছে কিনা জানি না, আপনার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিন এ নিয়ে আমাদের কথা হয়েছিলো। আপনি জানিয়েছিলেন যে এ দেশের নারীবাদীরা আপনার ওপর খুব খাপ্পা কারণ আপনি প্রকাশ্যে ধূমপান ও মদ্যপান করেন ও ছবি পাবলিক করেন। আমার সে কথোপকথন থেকেই আপনার প্রতি সহমর্মিতা ও সম্মান তৈরি হয়েছিলো। মনে হয়েছিলো, একজন মানুষ, সে নারী বা পুরুষ বা অন্য যে কোন জেন্ডারের হোন না কেন, তার সামাজিক মাধ্যমের ব্যক্তিগত একাউন্টে কী প্রকাশ করবে তাই দিয়ে তাকে বিচার করাটা অনুচিত এবং বেইনসাফ। বেগম আখতার, অ্যানড্রিয়া ডরকিন, মেরিলিন মনরো এমন অনেক নারী ব্যক্তিত্বের ধূমপানের ছবি আছে। আপনার ধূমপানের ছবি দেখে নারীবাদীদের ক্ষেপে যাওয়ার কী আছে?

আপনার সাক্ষাৎকার দেখতে গিয়ে একটা তথ্য জানতে পারলাম তা হচ্ছে ধূমপানের ছবি পাবলিকলি পোস্ট করলে জরিমানা দিতে হয়। আপনার সাক্ষাৎকার যিনি নিচ্ছিলেন তার বক্তব্য ছিলো এমন, সংবিধান অনুযায়ী ধূমপানের ছবি পোস্ট করলে জরিমানা এক লক্ষ টাকা। কথাটা তখনই আমার কানে লেগেছিলো। সংবিধান তো পেনাল কোড নয় যে তাতে জনগণের জন্য দণ্ড নির্ধারিত হবে! যদি হয়ও, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই ওই প্রেজেন্টারের কথা ঠিক, সংবিধান যখন লেখা হয়েছে, তখন তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিলোই না! ছবি পোস্ট করার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে! খটকা লাগায় খোঁজ নিয়ে জানলাম, ২০০৫ সালে প্রণীত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে আছে, কোন ব্যক্তি প্রকাশ্যে বা পাবলিক প্লেসে ধূমপান করলে অনধিক তিনশো টাকা জরিমানা করা হবে। আইনের এই ধারায় কয়েকটি উপধারা আছে এবং স্পষ্ট করে দেওয়া আছে যে তামাকজাতীয় পন্যের বিজ্ঞাপন করা যাবে না, সিনেমায় কাহিনীর প্রয়োজনে ধূমপানের দৃশ্য দেখাতে হলে সঙ্গে সতর্কবার্তা দিয়ে দিতে হবে। এই ধারা ভঙ্গ করলে অনধিক এক লক্ষ টাকা জরিমানা হবে। সুতরাং ছবি পোস্ট করলে এক লক্ষ টাকা জরিমানা দিতে হবে কথাটা অর্ধসত্য। এক লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান বিজ্ঞাপন, বিপণন ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ওই তিনশো টাকাই।

এখন আসি মূল পয়েন্টে, আপনি বলেছেন, ধূমপানের ছবি পোস্ট করে আপনি এক লক্ষ টাকা জরিমানা দিতেও প্রস্তুত আছেন। মিডিয়াওয়ালারা এই কথাটাকেই হেডলাইন করেছে। সাক্ষাৎকারে আপনি নিজেকে নারীবাদী বলে দাবী করেছেন, নারীবাদীদের প্রতি দুনিয়ার যে পরিমাণ ঘৃণা ও বিদ্বেষ তাতে মিডিয়ায় এসে এই দাবী করাও অত্যন্ত সাহসের কাজ। আপনাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু আপনি যদি মনেই করেন, প্রকাশ্যে ধূমপান করা নারীর অধিকার, তাহলে আপনার বলা উচিৎ ছিলো, আমি ছবি পোস্ট করবো এবং একটা পয়সাও জরিমানা দেবো না, কারণ এটা আমার অধিকার।

আপনার জানার কথা, নারী অধিকার আন্দোলনের প্রথম ধাপ ছিলো ভোটাধিকার। ভোটাধিকার কেবল নিজের মতামত প্রকাশ করাই নয়, একটি রাষ্ট্রের নাগরিক এবং সমাজের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতির প্রথম ধাপ। কিন্তু এ কথা কি জানেন, নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব সুসান বি এনথনি ১৮৭২ সালে বেআইনিভাবে ভোট দিয়ে গ্রেফতার হন। বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে ১০০ ডলার জরিমানা করা হয়, যা তিনি কোনদিনই পরিশোধ করেননি!

প্রিয় ফ্লোরা, পুরুষ নিয়ে আপনি যা ইচ্ছা বলতে বা করতে পারেন, সেটা আপনার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু নারীবাদ নিয়ে আপনি এরকম ছিনিমিনি খেলতে পারেন না। নারীর অধিকার আদায় করার, অর্জন করার, অর্জিত হলে উদযাপন করার জিনিস। কিন্তু নারীর অধিকার আপনি টাকা দিয়ে কিনতে পারেন না। কেননা এটি কোন পণ্য নয়।
উম্মে রায়হানা
উম্মে রায়হানা
জন্ম- ১৯৮৪ ময়মনসিংহ শহরে। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ এ স্নাতকোত্তর এবং জার্নালিজম, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন নিয়ে পরবর্তী মাস্টার্স। আগ্রহের জায়গা - মিডিয়া, ফেমিনিজমস, ফিল্ম, কবিতা, সমাজ আর সময়। পেশা- সাংবাদিকতা এবং গবেষণা। এক সন্তানের জননী, বিবাহ বিচ্ছিন্ন একলা মানুষ।

সর্বশেষ

নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা

জনপ্রিয়

মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
নীতুর লিপস্টিক
নীতুর লিপস্টিক