বাংলাদেশ
পরীক্ষামূলক প্রচার
28-Sep-2024
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
এম. শরীফ
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা

আমেরিকার কানেক্টিকাটের নিউ হেভেন-এ অবস্থিত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৭০১-এ স্থাপিত) ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত বেশ কিছু সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছিলো। এসব পরীক্ষার কর্ণধার ছিলো ঐ বিশ্ববদ্যালয়ের সামাজিক মনোবিজ্ঞানী স্ট্যানলি মিলগ্র্যাম।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এতো মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় স্ট্যানলি মিলগ্র্যামের মনে প্রশ্ন জাগে সৈন্যরা তাদের উর্ধ্বতন অফিসারদের হুকুমে মানুষ হত্যা কি সাবলীল ভাবে করতে সক্ষম নাকি ইচ্ছার বিরুদ্ধে করেছে?
চিন্তাটা তাকে এতো পেয়ে বসে যে ইয়েল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে একটি বড় পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন। 

ধাপে ধাপে বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষাটি হয়। সব মিলিয়ে মোট ৪০ জনের ওপর এই পরীক্ষা চালানো হয়। প্রত্যেককে চার ডলার করে দেওয়া হয়েছিলো। সে আমলে চার ডলার যথেষ্ট লোভনীয় ব্যাপার ছিলো। ইয়েল কর্তৃপক্ষ এই খরচ বহন করছিলো। বিভিন্ন পেশার এবং বিভিন্ন মানের লেখাপড়ার মানুষদের মধ্যে থেকে এই চল্লিশজনকে আনা হয় যাদের বয়সসীমা ছিলো ২০ থেকে ৫০ বছর।

এই পরীক্ষায় তিনজন থাকতো।

১. এক্সপেরিমেন্টর

২. টিচার

৩. লার্নার

ওই ৪০জন ছিলো এই টিচার গ্রুপে এবং তারা জানতো না যে তাদের ওপরেই পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। বরং তারা ভাবছিলো তারা এই পরীক্ষায় একজন সহকারী মাত্র। মূলত এক্সপেরিমেন্টর আর লার্নার ছিলো স্ট্যানলি মিলগ্র্যামের দলের লোক।

তারা অভিনয় করছিলো। টিচারকে বলা হতো সে কাগজ দেখে একটানা প্রশ্ন করে যাবে লার্নারকে। লার্নার আরেক কক্ষে বসে উত্তর দিতে থাকবে। ভুল উত্তর দিলেই টিচার একটি বোতামে চাপ দিয়ে লার্নারকে বৈদ্যুতিক শক দেবে। প্রতিটা ভুল উত্তরের জন্য ক্রমান্বয়ে উঁচুমাত্রার বৈদ্যুতিক শকের বোতামে চাপ দিয়ে যেতে হবে টিচারকে। সর্বশেষে প্রায় ৪৫০ ভোল্টের শক দেওয়ার বোতাম। সেটা চাপলে সমূহ সম্ভাবনা আছে যে লার্নার মারা যাবে।
প্রতিবার শক খাওয়ার পর লার্নার ব্যথার অনুভূতি প্রকাশ করতো,  চেঁচামেচি কান্নাকাটি করতো এবং পরীক্ষা ছেড়ে চলে যাবার হুমকি দিতো। এভাবে শক দিতে গিয়ে অনেক টিচার সংশয়ে ভুগতো। তখন তার কাছে বসা এক্সপেরিমেন্টর তাকে প্রশ্ন চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিতো এবং জানাতো এক্সপেরিমেন্টের সহকারী হিসেবে তাকে এটা করতে হবে। আরো নানান ভাবে তাকে সাহস দেওয়া হতো। দেখা হতো এসব উৎসাহব্যাঞ্জক কথা শুনে টিচার সর্বোচ্চ ইলেকট্রিক শকের(৪৫০ ভোল্ট) বোতাম চাপে কিনা। পাশের ঘরে একটি লোক খামোখাই বৈদ্যুতিক শক খেয়ে মারা যেতে পারে জেনেও টিচার সেই বোতামে চাপ দেবে কিনা।

অল্প অল্প করে হতে হতে এক সময় যখন সকলের ওপর পরীক্ষা সম্পন্ন হলো। তখন ফলাফল পর্যালোচনা করে স্ট্যানলি মিলগ্র্যামের চোখ কপালে উঠে গেলো। তার ও তার দলের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি লোক প্রাণঘাতী বৈদ্যুতিক শক দিয়েছে। শতকরা পঁয়ষট্টি ভাগ লোক এই ভয়াবহ কাজটি করেছে।

মিলগ্র্যামদের ধারণা ছিলো হয়তো শতকরা বড়জোর তিনভাগ লোক এমন করলেও করতে পারে। কিন্তু তা পঁয়ষট্টি ভাগ পর্যন্ত যাবে কেউ ভাবেনি। পুরো ব্যাপারটাকে মিলগ্র্যাম নাম দেয় ওবিডিয়েন্স টু অথোরিটি।
কিছু লোক বেশি বৈদ্যুতিক শক দিতে রাজি হয়নি, কেউ কেউ চার ডলার ফিরত দিয়ে পরীক্ষা ত্যাগ করতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম। ৪০ জনের সবাই পরীক্ষার এক পর্যায়ে সংশয়ে পড়ে গিয়েছিলো এবং বারবার এক্সপেরিমেন্টরের উৎসাহ পেয়ে এগোতে থাকে। অবশেষে প্রাণঘাতী শক দিয়েছে শতকরা ৬৫ জন।

মিলগ্র্যামের এই পরীক্ষাটিকে জিওনিস্ট গ্রুপগুলো হিটলারের নাৎসি বাহিনী দ্বারা হলোকস্ট ঘটানোর পক্ষে একটি প্রমাণ হিসেবে দেখায়।

তারা এটাকে প্রামাণিক পরীক্ষা হিসেবে দেখালেও বেশ কিছু সমালোচনা রয়েছে। 

তা হলো পরীক্ষাটি হয়েছে মাত্র ৪০ জনের উপর। আরো বড় পরিসরে না করে প্রথমেই এতো গুরুত্ববহ নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন বৈকি।

এছাড়া একেক শহরে একেক রকম ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। একেক দেশেও একেক রকম ফলাফল আসার সম্ভাবনা থাকে।

তারপরও এই মিলগ্র্যাম এক্সপেরিমেন্ট থেকে একটা ব্যাপার আন্দাজ করা যায় যে কর্তৃপক্ষের চাপের ফলে মানুষ খুন পর্যন্ত করতে পারে।

তবে এ কথাও ঠিক যে অথোরিটির প্রতি ওবিডিয়েন্স ছাড়াও পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ খুন খারাপি হয়ে থাকে। এ রকম খুন-খারাপিতে সিদ্ধহস্ত কেউ যদি ৪০ জনের মধ্যে ঢুকে থাকেন, তবে পরীক্ষাটির ভিত্তি অনেকটাই নড়ে যায়।

সূত্র: 

১. ওবিডিয়েন্স টু অথোরিটি: এন এক্সপেরিমেন্টাল ভিউ - স্ট্যানলি মিলগ্র‍্যাম।
২. লে সিস্টেম কন্সেন্ট্রেসিওনেয়ার নাজি - ওলগা উরমসার মাইগট।

৩.  দ্য রুডল্ফ রিপোর্ট - জেরমার রুডল্ফ। দ্য লিউখটার রিপোর্টস - ফ্রেডারিখ এ. লিউখটার।
এম. শরীফ
এম. শরীফ
দেশ বগুড়া, জন্ম যশোরে। স্কুল-কলেজ ঢাকায়, আজকের কাগজে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছেন, পেশায় চিকিৎসক।

সর্বশেষ

নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা

জনপ্রিয়

মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
নীতুর লিপস্টিক
নীতুর লিপস্টিক