একবার ১৪ই এপ্রিল মোতাবেক ১লা বৈশাখে দেখলাম একদল তরুণ একটা পিকআপের উপর একটা খেঁজুর গাছ বসিয়ে তার চারদিকে নিজেরা হই-হুল্লোড় করতে করতে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাঙালী সংস্কৃতিকে ভালবেসে তারা খেঁজুর গাছটিকে সেদিন কোরবানী করেছিল। আমরা তখন বাঙালী সংস্কৃতিকে প্রচুর ভালোবাসলেও কখনো এতবড় কোরবানী দিতে পারি নাই। একটা আস্ত খেঁজুর গাছ কেটে নিয়ে এসে সেইটা নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করার মধ্যে এক বিরাট অভিনবত্ব আছে। সুতরাং লোকজন তাদের খেঁজুরগাছ সমেত পয়লা বৈশাখ উদযাপনের এই তরিকায় অভিভূত হয়েছিল। ঘটনাটা যখন প্রত্যক্ষ করেছিলাম তখন আমি ইউনিভার্সিটিতেপড়ি। প্রতি বছর এপ্রিলের ১৪ তারিখে যখন পয়লা বৈখাশ আসে বলে টের পাই তখন আমার সেই কর্তিত খেঁজুর গাছটার কথা মনে হয়। গাছটা হয়ত এখনো বেঁচে থাকতে পারত। খেঁজুর গাছ অনেক দিন বাঁচে। অবশ্য মাঝে মাঝে মনে হয় খেঁজুর গাছ তো কেটে ফেলা ভালো, এতে কাঁটা থাকে আর খেঁজুর গাছ ঠিক বাঙালী কিনা এই নিয়ে আমাদের কালচারাল পুরোহিতদের মাঝে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। তবু আমার অবুঝ মন পয়লা বৈশাখে সেই খেঁজুর গাছটার কথাই ভাবে।
আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সংস্কৃতি জগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ভণ্ডামী ও প্রতারণার বসবাস তারই একটা উজ্জ্বল নজীর হল পয়লা বৈশাখ। সেই ভান ও ভণ্ডামী এখন এমন একটা পর্যায়ে এসে গেছে যে এটা এখন একটা ফ্যাসিবাদী রূপ পরিগ্রহ করেছে। আমাদের কালচারাল এলিটরা আমাদেরকে বয়ান দেন যে আমরা এই বৈশাখে আমাদের শেকড়ে ফেরার চেষ্টা করি। কিন্তু বাস্তবতা এর বিপরীত। বৈশাখী উৎসব আয়োজনের পরতে পরতে আছে শেকড় কাটার প্রচেষ্টা। পয়লা বৈশাখ আয়োজনে যে অনুষঙ্গগুলো আছে এর কোনওটিই আমাদের আবহমানকাল ধরে এই দেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে আচরিত নয়। এই অনুষঙ্গের বড় আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রা। মুখোশ পরা এবং নানা মূর্তি-প্রতিমূর্তির এই শোভাযাত্রার সাথে আমাদের তৃণমূল গণমানুষের কি সম্পর্ক সে বৈজ্ঞানিকের গবেষণার অতীত। এই দিনের আরেক বড় অনুষঙ্গ হল পান্তা ইলিশ। এটাও আসলে আমাদের আবহমান কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠির সাথে একটা তামাশা।
এইসব কালচারাল পুরোহিতদের আরো একটি মজার ভান হলো, এই বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রাকে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ বলে প্রচার করা। এই আয়োজনের প্রায় সব বিষয়ই সাম্প্রদায়িক এবং এদের ভিত্তি হচ্ছে ধর্মীয় দেব-দেবীকে আশ্রয় করে। অথচ আবহমানকাল ধরে আমরা যেসব বিষয়কে পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গ হিসেবে পালন হতে দেখেছি তার কোনটিই আমাদের কালচারাল পুরোহিতদের আয়োজনে থাকে না। পহেলা বৈশাখের সাথে যে বিষয়টি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত তা হল হালখাতা। এই হালখাতার অনুষ্ঠানে সব সময় দেখেছি মিলাদ হত আর মিষ্টি বিলানো হত। শুধু হালখাতা কেন আজন্ম দেখেছি বাংলার মানুষ যে কোন ভালো কাজের শুরুতেই মানুষ মিলাদ দিত। নতুন বাড়ি, নতুন ঘর, নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নতুন যে কোনও কিছু মানেই একটা মিলাদের অনুষ্ঠান। সেই হিসেবেও নতুন বছরের শুরুটা একটা মিলাদ দিয়েই হবার কথা। এখন এই কথা যদি আমাদের কালচারাল এলিটদের বলতে যান তবে আপনি হবেন সাম্প্রদায়িক পিশাচ।
তাও সমস্যা ছিল না। সবাই স্বাধীন। যার যা ভাল লাগে করবে, করুক। আমি যদি পহেলা বৈশাখে মিলাদ দিতে চাই, আরেকজন মঙ্গল শোভাযাত্রা করতেই পারে। তার হয়ত মঙ্গল লক্ষ্মী পেঁচাতে, হনুমানের আশীর্বাদে তার শুভ সূচনা। সে তার মত করুক তাতে কিছু মনে করি না। শুধু এইটুকু চাই সে যেন অন্যদের না বলে তোমাকেও লক্ষ্মী পেঁচার মুখোশ পরতে হবে। হনুমানের আশীর্বাদ নিতে হবে আর মিলাদ ছাড়তে হবে। মিলাদ পড়লে তুমি পিশাচ আর লক্ষ্মী প্যাঁচার মুখোশ পরলে তুমি সার্বজনীন। তখন তো একটা বড় প্রশ্ন দেখাই দেয়।
সবচেয়ে বড় আইরনি হচ্ছে যেসব পুরোহিতরা এই বৈশাখ নিয়ে মাতামাতি লাফালাফি বেশি করে তাদের কেউ বাংলা সংস্কৃতির ধার ধারে না। এদেরকে ১৪ই এপ্রিল ছাড়া আর সারাবছরে অন্য কোনও দিন বাংলা তারিখ তো দূরে থাকুক বাংলা মাসের নাম জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না। কিন্তু যাদের বছর কাটে বাংলা মাসের হিসেব করে সেই সব কৃষকের সংস্কৃতির সাথে কোনও দূরতম সম্পর্কহীন উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত কিছু কার্যকলাপকে বলা হচ্ছে আমার বাপদাদা চৌদ্দপুরুষের সংস্কৃতি। অথচ আমার বাপদাদারা এসব চিন্তাও করেনি।
কালচালার এলিটরা তাদের কল্পনাপ্রসূত এইসব উৎসবের অনুষঙ্গ তৈরি করেছিল আর শহুরে শিক্ষিত উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তের একটা অংশের মাঝে এটা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।সংস্কৃতির কিংবা শেকড় হিসেবে নয়, একটা ফূর্তির অনুষঙ্গ হিসেবেই এর বিস্তার। ধীরে ধীরে এগুলোকে বলয়ের বাইরে বের করার চেষ্টা হচ্ছে। রাজধানী থেকে পাঠানো হচ্ছে বিভাগীয় শহরে, জেলা-উপজেলায়। স্কুল-মাদ্রাসার বাচ্চাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে এইসব উৎকট আয়োজন। শেকড়ে ফেরার চরিত্রটা তোএ খানেই মার খায়। শেকড়ে ফেরার হলে তো প্রত্যন্ত অঞ্চলে, তৃণমূলে বছরের পর বছর আচরিত হয়ে একটা পোক্ত আসন নিয়ে নিজেই ধাববান থাকার কথা। তৃণমূল থেকে বিত্তবানের ড্রইংরুমে আসার কথা। তাতো নয়! ফলে এতো যেন পুত্রের ঔরসে পিতার জন্ম! তাহলে এখানে আমরা কোন্ শেকড়ে ফিরছি? কল্পনাপ্রসূত নব্য আবিষ্কৃত আচার সংস্কৃতির নামে চাপিয়ে দিচ্ছি সাধারণের উপর।এই ধরনের বাস্তবতায় ইংরেজী নববর্ষ আর বাংলা নববর্ষের উৎসবের চরিত্রগত ও তাৎপর্যগত তফাত কোথায়? দুটোই ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে। দুটোতেই সরকারকে নিরাপত্তা বিধানে গলদঘর্ম হতে হয়। দুটোতেই মেয়েদের শ্লীলতাহানির, যৌন নিপীড়নের উদাহরণ আছে।
আবার ফিরে যাই সেই কর্তিত খেঁজুর গাছের কাছে। সংস্কৃতির নামে খেঁজুর গাছ কেটে রাস্তায় রাস্তায় নামা যেমন একটা তামাশা, প্রাণ-পরিবেশের ক্ষতি, সর্বোপরি একটা খেঁজুর গাছকে শেকড়হীন করা, তেমনি কালচারাল এলিটদের এই রকম জগাখিচুড়ি মার্কা পয়লা বৈশাখ উদযাপন আমাদেরকেও শেকড়হীন করার প্রচেষ্টা। পয়লা বৈশাখেএই দেশের মানুষের অবস্থা এখন সেই কর্তিত খেঁজুর গাছের মত। নিজের বিসর্জিত শেকড়ে অন্যের উৎসবের সঙ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো, তারপর গিয়ে মরো কোনও এক ভাগাড়ে অথবা জ্বলেপুড়ে মরো কারো উনুনে।