বাংলাদেশ
পরীক্ষামূলক প্রচার
01-Jul-2024
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
পিনাকী ভট্টাচার্য
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী

বছর কয়েক আগে আমি লিখেছিলাম বাংলাদেশের বেশীরভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী। অনেকে এতে রুষ্ট হয়েছেন, এর ব্যাখ্যা চেয়েছে।

বাংলাদেশের বামেরা নিজেদের অতীত লুকাতে এতই ওস্তাদ যে তাঁদের নিজের দলিল দেখালে আপনার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। এদের অতীত এত কলঙ্কময়। ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে। কিন্তু বামশক্তি বলে প্রধাণত যারা মাঠ গরম করতেছেন এখনো তাঁদের নাম ধরে ধরে কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।

কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য জ্ঞান চক্রবর্তী ‘ঢাকা জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের অতীত যুগ’ বইয়ে লিখেছেন, “...কারণ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে পার্টি এখানকার আপোষবাদী বুর্জোয়া নেতৃত্বের উপরে নির্ভর করিয়াছে, শ্রমিকশ্রেণীকে স্বাধীনভাবে ক্ষমতা দখল করিতে আহবান জানায় নাই এবং পার্টি সংগঠন ও তাহার নেতৃত্বে একটি কঠোর শৃঙ্খলা সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টিতে পরিণত না হইয়া একটি সৌখিন পেটিবুর্জোয়া পার্টিতে পরিণত হইয়াছে।” তাছাড়া তিনি নেতাদের সর্ম্পকে বলেছেন,“---চূড়ান্ত হঠকারিতা ও বালসুলভ চাপল্যের পরিচালক”

আসুন এইবার দেখি এই সৌখিন পেটি বুর্জোয়া পার্টির হঠকারি ও বালসুলভ চাপল্যের নেতারা কী কী সর্বনাশ করেছেন।

বৃটিশ আমলে যখন কৃষক প্রজা পার্টি এবং পরবর্তিতে মুসলিম লীগ জমিদারি উচ্ছেদের লড়াই করছে তখন এই কমিউনিস্টরা জমিদারি প্রথা বহাল রেখেই তেভাগার আন্দোলন করেছে। জমিদারি প্রথ উচ্ছেদ যে একটা প্রগতিশীল পদক্ষেপ এবং প্রত্যক্ষ শ্রেণী সংগ্রাম সেই হুশ তাঁদের হয়নি।

ভারত ভাগ হওয়ার জন্য এরা জিন্নারে দোষ দেয়। অথচ সেই কমিউনিস্ট পার্টির ১৯৪০-৪১ সালের মুখপত্রে-পিপলস ওয়ার (জনযুদ্ধ) জানা যায়, কংগ্রেস ভারত বিভাগে সম্মতি দেওয়ার ঢের আগে, যখন রাশিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয় নাই, তখন তারা ভারতবর্ষ যে বিভক্ত হওয়া উচিত সে বিষয়ে অভিমত প্রকাশ করে। এবং ভারতবর্ষের কোন্ অংশ কোথায় যাবে, তাও এঁকে দেন। এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। অতুল ঘোষ আরও লিখেছেন,“তাদের প্রস্তাবিত ম্যাপে শুধু ভারত ভাগ নয়, বাঙ্গালা ও পাঞ্জাবকে বিভক্তির ফর্মুলাও দিয়েছিল ঐ কমিউনিস্টরাই।”

সুত্রঃ হায় কমিউনিস্ট পার্টি হায় বিপ্লব, আবির হাসান ডাকঘর প্রকাশনা পৃষ্ঠা ১২

এই কমিউনিস্টরা ১৯৫১ সালে মেজর জেনারেল আকবর আলী খানকে দিয়ে পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুথ্যান করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। যা রাওয়ালপিন্ডি কন্সপিরেসি নামে পরিচিত। এই সামরিক অভ্যুথ্যান চেষ্টা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে অস্থিরতা, ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে; যার ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্বে অনাস্থা তৈরি হয় এবং এই ঘটনা দীর্ঘমেয়াদে সামরিক শাসনের পথ খুলে দেয়। এইকারনেই পুরো পাকিস্তানের কালপর্বে সিপিবির পূর্বসুরি পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল।

এরা বলে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকেরা কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বলেনা তাঁরা ক্যু করতে গেছিল।

তাঁরা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চ্যাম্পিয়ান বলে দাবী করে অথচ মুক্তিযুদ্ধের একমাস আগে মাত্র ২৫ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ তাঁরা ৫ দফা দাবী পেশ করে। সেই দাবীনামার তৃতীয় দফায় তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতা করে লেখে।

“কিছু উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী তথাকথিত স্বাধীন পূর্ব বাংলার নামে অবাঙ্গালীবিরোধী জিগির তুলিয়া এবং মওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়াজ তুলিয়া জনগণের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণবিরোধী মনোভাব গড়িয়া তুলিয়া অবস্থাকে আরও জটিল ও ঘোরালো করিয়া তুলিতেছে।“

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড) পৃষ্ঠা ৬৫৭

মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তানি শাসকদের সাথে তাঁরা কোন সংঘাতে যায়নি। মার্কিন চীন সমঝোতা গড়ে তোলার জন্য তখন আইয়ুব খান দূতিয়ালীর ভূমিকা নিয়েছে। এই অবস্থায় পিকিং পন্থীরা বেশিরভাগই 'ডোন্ট ডিস্টার্ব' আইয়ুব লাইন নিয়ে চলছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময়েও কিছু বামদল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে।

পাকিস্তান আমলে আমরা বিনিয়োগ বৈষম্যের কথা বলেছি। বলেছি এই পুর্ব পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এরপরে স্বাধীন দেশে পুঁজির বিকাশের পথ এই বামেরাই রুদ্ধ করেছে। সমাজতন্ত্র নামে এক অস্পষ্ট ভুতুড়ে কথাবার্তা তুলেছে। সমাজতন্ত্র নামে এই ভূতুড়ে ধারণার আসল অর্থ যাই হোক বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজটাকেই অর্থনৈতিক এজেন্ডার বাইরে নিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের পুজির বিকাশ কীভাবে হবে সে প্রশ্নটাকে হারিয়ে ফেলেছে।

এরপরে আসেন বাকশাল।

বাকশাল মুলত ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা রিপাবলিকের ভিত্তিকে তছনছ করে দেয়। আরো স্পষ্ট করে বললে বাংলাদেশ নামের যেই রাষ্ট্র ১৯৭১ এ তৈরি হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রটাকেই কার্যত ধ্বংস করে দেয়। বাকশাল কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গঠিত রাষ্ট্রকে ধ্বংস করেছিল? করেছিল দুভাবে।

১/ বাকশাল যেই আইনে হয় সেই চতুর্থ সংশোধনী আইন ১৯৭৫-এ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১ সংশোধন করে বলা হয়েছিল, ‘Effective participation by the people through their elected representatives in administration at all levels shall be ensured’ shall be omitted’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় সংশোধনের আগের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১ তে প্রশাসনের সর্বস্তরে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণের যে কথা বলা ছিল এখন তা বাতিল করে দেয়া হল। অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সোজা বাংলায় শাসক নির্বাচনের ক্ষমতা আর রাষ্ট্রীয় কাজে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে জনগনের অংশ নেয়ার ক্ষমতা থাকলো না।

২/ সংক্ষুব্ধ কোন নাগরিকের আদালতে যাবার যে মৌলিক অধিকার ৪৪ অনুচ্ছেদে স্বীকৃত ছিল বাকশাল সংশোধনীতে মৌলিক অধিকারের খোদ সেই ৪৪ অনুচ্ছেদকেই বিলুপ্ত করে দেয়া হয়। একই সাথে ১০২ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টেকেও ৪৪ অনুচ্ছেদে দেয়া রীট করার অধিকার শুনার ও আমলে নিবার অধিকার দেয়া ছিল । অর্থাৎ সংক্ষুব্ধ কোন নাগরিকের আবেদন শুনতে এবং প্রতিকার দিতে সুপ্রীম কোর্টের যে অধিকার ছিল এবং প্রতিকার হিসাবে নির্বাহী বিভাগকে আদেশ দেবার আদালতের ক্ষমতাকেও একইসাথে বাতিল করা হয়।

সোজা কথায়, চতুর্থ সংশোধনী আইন রাষ্ট্রের নাগরিকের সংক্ষুব্ধ হবার মৌলিক অধিকার রদ করেছিল। এবং রাষ্ট্রকে লাগামহীন ক্ষমতা দিয়েছিল। এমন লাগামহীন ক্ষমতা পেলে তা আর রিপাবলিক থাকেনা, রাষ্ট্রই থাকে না । জনগনও আর নাগরিক থাকেনা। এটা হয়ে যায় এক মনার্কির রাজত্ব আর জনগন হয়ে যায় প্রজা।

বাকশাল বাংলাদেশের মানুষকে নাগরিক থেকে প্রজাতে রিডিউস করেছিল, আর বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে রিপাবলিক থেকে কার্যত রাজতন্ত্রে রিডিউস করেছিল।

এই বাকশালের দায় কি বামদের নাই? সিপিবি তো দলের অস্তিত্ব বিলীন করে বাকশালে যোগ দিয়েছিল।

তামাশা হল, আজ বামেরা কারো কারো “মরাল কম্পাস” বলে বিবেচিত হয়। যারা ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে কখনো একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না, যাদের বাংলাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক মোড় বদলের সময় গণ আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তাঁরা যদি দেশের মরাল কম্পাস হয় তাহলে দেশের সামনে আরো দুর্গতি ছাড়া আর কী থাকবে?

বাংলাদেশের বামদের সম্পর্কে বন্ধুদের মোহমুক্তি ঘটুক, এই কামনা করি।

পিনাকী ভট্টাচার্য
পিনাকী ভট্টাচার্য
ব্লগার, অনলাইন একটিভিস্টপ্রকাশিত বই: ধর্ম ও নাস্তিকতা কমিউনিস্টদের ভ্রান্তি পর্ব, বালাই ষাট, ওয়েদার মেকার, চীন কাটুম

সর্বশেষ

নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা

জনপ্রিয়

মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
নীতুর লিপস্টিক
নীতুর লিপস্টিক