বাংলাদেশ
পরীক্ষামূলক প্রচার
01-Jul-2024
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
আবু মুস্তাফিজ
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল

যৌন দাসত্ব বা যৌন শোষণ লইয়া উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞাটা যুৎসই।

উইকি'র মতে, এক বা একাধিক ব্যক্তির (এখানে নারী বললেই যথোপযুক্ত হয়) উপর মালিকানার জোরে কিংবা অন্য কোনও উপায়ে তাদের জোর জবরদস্তি কিংবা অত্যাচারের মাধ্যমে যৌন ক্রিয়াকলাপে বাধ্য করা।

অর্থাৎ যৌন দাসত্ব বা শোষণের সঙ্গে মালিকানা জড়িত কিংবা মালিকানার মতো কিছু একটা। সেইসাথে জোর জবরদস্তি ও অত্যাচার।

এসব ব্যাপার খেয়াল করলে একটা জিনিস পরিষ্কার হয় যে সারা দুনিয়াতেই নারীর উপর যৌন দাসত্ব চলমান, তবে সেটা সাধারণত যৌন পল্লীগুলোতে বা রেড লাইট এরিয়ায় দেখা যায়।

অন্যত্র যে ঘটে না, তা নয়, তবে তার সুযোগ কম।

অথচ আমাদের মতো বিচারহীন রাষ্ট্রে, যেখানে মানুষের ভোটের অধিকার নাই, ভাতের অধিকার নাই, কথা বলার অধিকার সঙ্কুচিত, গুম খুন আর দুর্নীতি লুটপাটে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, সেখানে যৌন দাসত্বের ব্যাপ্তি কেবল যৌনপল্লীতে ঠেকে নাই, এ নিশ্চিত করেই বলা যায়।

এর জ্বলন্ত প্রমাণ দিল ইডেন কলেজের মেয়েরা, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগেরই একাংশের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, দলের সভাপতি সাধারণ সম্পাদক মিলে এই র‌্যাকেটটি চালান।


তারাই জোর করে হলে থাকা মেয়েদের দলীয় নেতাদের কাছে পাঠান। বাদ থাকেন না ধনী ব্যবসায়ীরাও।

যেসব মেয়ে যেতে অস্বীকার করেন, তাদের উপর নেমে আসে নানা ধরনের অত্যাচার নিপীড়ন, মানসিক থেকে শারীরিক, কোনওটাই বাদ যায় না।

যৌন দাসত্বের সংজ্ঞার সাথে পুরো ব্যাপারটিই মিলে যায়।

এ রকম একটা দমবদ্ধ পরিস্থিতিতে নিপীড়নের শিকার, যদি কেউ তা হয়ে থাকে, সেসব মেয়ের পাশে দাঁড়ানোর কথা ছিল নারীবাদী সংগঠনগুলোর।

উচিত ছিল, অভিযোগটি খতিয়ে দেখার, তদন্ত করে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা।

সেইসাথে অভিযোগকারী মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।

অথচ বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন, নারীনেত্রী কিংবা নারীবাদী হিসাবে যারা তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার, তাদের প্রায় কেউই এ বিষয়ে মুখ খোলেননি।

তবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল এ ব্যাপারে কথা বলেছেন।

তার মতে, দায়টা শুধু ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের নয়।

বেশ, দায়টা তাহলে কার?

উনি দায় চাপাতে বলেন, সামগ্রিকভাবে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটা ন্যক্কারজনক জায়গায় চলে গেছে। ইডেন কলেজে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, এর প্রভাব হবে সুদূর প্রসারী। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, নারীবিদ্বেষী শক্তিগুলোকে নারী শিক্ষা, নারীর অগ্রযাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেওয়া হল।

উনার বক্তব্য পড়িয়া কিছু কি বুঝা গেল? এর জবাবটাও কঠিন, কেন, আসেন ব্যাখ্যা করি।

উনার কথামতে, বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটা ন্যক্কারজনক জায়গায় পৌঁছে গেছে। কথা সত্য, এই কথা আমরাও মানি ও জানি।

ইডেন কলেজে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রভাব যে সুদূর প্রসারী হবে, এ কথাও না হয় মানা গেল।

কিন্তু উনার শেষ কথাটি বেশ মজার, এ ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কিংবা নারীবিদ্বেষী শক্তিগুলো নারী শিক্ষা আর নারীর অগ্রযাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবে বলে উনি দাবি করেছেন।


এখন আপনারাই বলুন, আপনার মেয়েকে একটা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াতে পাঠিয়েছেন, এইজন্য যে আপনার মেয়ে পড়ালেখা শিখবে, দেশের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে উঠবে, মানুষ হবে, চাকরি বাকরি করবে কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য করে স্বাবলম্বী হবে, এই তো?

কিন্তু সেখানকার ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন যদি তাকে জোর করে বিভিন্ন নেতার বাসায় পাঠায়, ব্যবসায়ীদের কাছে পাঠায় এবং আপনার মেয়ে বাধ্য হয় সেখানে যেতে, তাহলে আপনি কী করবেন?

ধরে নিলাম, আপনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোক এবং নারীবিদ্বেষী নন, তারপরও কি আপনি চাইবেন, আপনার মেয়ে যৌনদাসীরূপে পড়াশোনা শিখুক?

আমার ধারণা, সুলতানা কামাল এই প্রশ্নের আশঙ্কায় আতঙ্কিত। তাই উনি যাতে এই প্রশ্নটি কেউ করতে না পারে, সেজন্য আগেভাগেই প্রশ্নকারীকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং নারীবিদ্বেষী বলার সুযোগ রেখে দিয়েছেন।

ভেরী ইন্টারেস্টিঙ!

তার চাইতেও মজার ব্যাপার হলো, এইসব কথা বলার মাধ্যমে সুলতানা কামাল কিন্তু একবারের জন্যও অভিযোগ অস্বীকার করেন নাই, যে ইডেন কলেজে যৌন দাসত্ব নাই।

বরং তার কথা শুনলে বুঝা যায়, অভিযোগ বিষয়ে উনি ইচ্ছা করেই বেখেয়াল। অথচ এই অভিযোগের পরিণাম কী হতে পারে, সেইটা নিয়ে বরং উনি বেশি চিন্তিত।

কেন? কারণটা কী?

কারণ উনি ভালোমতোই জানেন, ইডেন কলেজ হইতে শুরু করিয়া দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরও কত বিচিত্র ও ভয়াবহ সব নিপীড়নের শিকার হয় নারী শিক্ষার্থীরা।

কেবল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির লোকজন এই নিপীড়নের সাথে জড়িত বলে উনারা এইসব চাইপা যান।

এজন্য অভিযোগ তদন্তে উনার বিন্দুমাত্র মতি নাই, বরং উনার সকল চেষ্টা কী করিয়া প্রশ্নকারীদের থামানো যায়, সেই লইয়া।

তাই উনি এইসব 'মুক্তিযুদ্ধবিরোধী', 'নারীবিদ্বেষী' মুখস্ত ট্যাগিংয়ের রাজনীতি করেন।

এইজন্যই যে কেউ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হইবার ভয়ে, নিজেকে নারীবিদ্বেষী হিসাবে দেখতে না চাওয়ার বিনিময়ে এইরকম ন্যক্কারজনক অভিযোগের পরও মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন।

ঠিক তাই-ই হয়েছে, ঘটনার এতদিন পরেও কেউ এ লইয়া আর কোনও প্রশ্ন তোলেন নাই, না নারী না পুরুষ, না মুক্তিযুদ্ধবিরোধী না নারীবিদ্বেষী কেউ।

হেফাজত কিংবা ধর্মান্ধ মোল্লাদের (!) কথা নাই বললাম এক্ষেত্রে, যেহেতু সুলতানা কামালও তাদের লইয়া কিছু বলেন নাই তার বক্তব্যে।

তাহলে পুরো ব্যাপারটা এখন কী দাঁড়াইল?

দাঁড়াইল এই যে যৌন দাসত্বের অভিযোগ কিংবা দায় লইয়া সুলতানা কামালদের কোনও মাথাব্যথা নাই।

ফলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের কোনও ছাত্র সংগঠন যদি উপঢৌকন দিয়ে, টাকা পয়সার প্রলোভন দিয়ে কিংবা ক্ষমতার গরম দেখিয়ে সহপাঠীদের একটু আধটু অত্যাচার নিপীড়ন করেই থাকে, তাতে দোষের কিছু নেই।

আর করলেও তো করেছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের কোনও নেতা কিংবা শিল্পপতি ব্যবসায়ীর জন্য, তাতে অসুবিধাটা কোথায়?

বরং এইটাই কি কথিত ‘প্রগতিশীলতা’, এইটাই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়?

ফলে এই লইয়া কথা বলার বা কী আছে?

এই লইয়া যে বা যারা কথা বলবে, প্রশ্ন তুলবে তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামাত শিবির রাজাকার, নারীবিদ্বেষী মিছা-জিনিস থুড়ি মিসোজিনিস্ট।


আবু মুস্তাফিজ
আবু মুস্তাফিজ
জন্ম ১৭ অক্টোবর, ১৯৭৬, টাঙ্গাইল। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, সরকার ও রাজনীতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত বই : গল্পগ্রন্থ— লুহার তালা [শুদ্ধস্বর, ২০১০], একটি প্রাকৃতিক সাইন্স ফিকশন: শিন্টু ধর্মাবলম্বী রাজা, সবুজ ভদ্রমহিলা ও একজন অভদ্র সামুকামী [গুরুচণ্ডা৯, কলিকাতা, ২০১২], ট্যাকারে ট্যাকা [শুদ্ধস্বর, ২০১৪]

সর্বশেষ

নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা

জনপ্রিয়

মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
নীতুর লিপস্টিক
নীতুর লিপস্টিক