বাংলাদেশ
পরীক্ষামূলক প্রচার
29-Jun-2024
শিক্ষা ব্যবস্থা: গোড়ায় গলদ
মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খান
শিক্ষা ব্যবস্থা: গোড়ায় গলদ

যে জিনিসের শুরুটা ভাল হবে, তার শেষটা ভাল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে গোড়ায় গলদ, তাই ভাল টা আশা করতে পারছি কই? প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা শুরু হবে আনন্দের সাথে। সেটা প্রাইমারী স্কুলেই হোক কিংবা মাদ্রাসায়। সরকার আইন করেছেন জাপানে, কোরিয়ায় শিশুদের মারা হয় না, আমাদের দেশেও মারা যাবে না।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধু বেত্রাঘাত বন্ধ করলেই সব হয়ে যায় না। শিশুদের আনন্দময় পরিবেশ পড়াশোনায় আগ্রহী করাই আসল কথা। অন্যদিকে কিন্ডারগার্টেনে ভাল পরিবেশ ও যত্ন নেয়ার নাম করে শিশুদের উপর একগাদা বই চাপিয়ে দেয়া হয় যা আরও বেশি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি।

প্রথমেই আসি জাপান প্রসঙ্গে:

জাপান বিশ্বের ১ম সারির উন্নত দেশ। শুধু আর্থিক নয়, সামাজিক, মানসিক, ব্যক্তিগতভাবেও তারা উন্নত। এসব মিলিয়ে জাপানের অবস্থান বিশ্বে ১ম বলা যায়। তো এহেন দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের মারার প্রয়োজন হয় না। কেন হয় না? ঐ যে বললাম সামাজিক ও মানসিকভাবেও তারা উন্নত। গোটা আর্থ সামাজিক অবকাঠামো এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত যে শিশু জন্মের পর হতে খুবই চমৎকার পরিবেশে বেড়ে উঠছে। স্কুলের যাওয়ার আগেই পরিবার, সমাজ তাকে শিখিয়ে দিচ্ছে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে। তাই জাপানি শিশুরা বেড়ে উঠছে বিশ্বের সবচাইতে ভদ্র ও দায়িত্বশীল হিসেবে।

সেখানকার বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে যারা আসেন, তারা যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও শিশুদের কোথায় দুর্বলতা রয়েছে তা বের করে সমাধান করতে পারঙ্গম। আর প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ভাতা সুযোগ সুবিধা সম্মান অন্যান্য গ্রেডের শিক্ষকদের তুলনায় কম তো নয়ই বরং বেশি।

আমাদের আর্থ সামাজিক অবস্থার সাথে মিল রেখে কোন দিনই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয় নি। ফলে অবস্থা হয় বারো হাত কাঁকুড়ের তের হাত বীচি'র মতো।

আমাদের দেশে কিছু উচ্চ বিত্ত পরিবার ছাড়া বাকিদের পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় সাধারণত প্রাইমারি স্কুল/ কিন্ডারগার্টেন কিংবা মাদ্রাসায়। এসব প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে শিক্ষা পরিস্থিতিও পাল্টে যায়। তাছাড়া আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায় একেক শিশু একেকভাবে বেড়ে উঠছে, আলাদা আলাদা শিক্ষা পেয়ে। ফলে তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ভয়ানক শ্রেণী বিদ্বেষ।

আবার রয়েছে তাদের গিনিপিগ বানানোর প্রচেষ্টা! স্কুল কলেজে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি শুরু করা হয় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়াই। শিক্ষকরাই যেখানে সৃজনশীল পদ্ধতি জানে না, সেখানে ছাত্ররা কি শিখবে!

আবার রয়েছে গণহারে জিপিএ ফাইভ দেয়া, পাশের হার বেশি দেখানো,কাউকে ফেল না করানো ইত্যাদি ইত্যাদি চাপ। ফলে শিক্ষকগণ না পারছে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে, না পারছে শিক্ষার্থীরা মেধার বিকাশ ঘটাতে। ফলাফল সহজেই অনুমেয়।

শিক্ষক নিয়োগে রয়েছে বিশাল দুর্বলতা। যে স্তরে শিক্ষার্থীদের ভিত্তিমূল গড়া হবে, সেখানে শিক্ষকদের হতে হবে সবচাইতে মেধাবী। অথচ এই সেক্টরে রয়েছে বিশাল দুর্বলতা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় পুরুষ স্নাতক পাশ আর মহিলা এসএসসি পাশ। আর নিয়োগ প্রক্রিয়া কোনকালেই স্বচ্ছ থাকেনি। ফলে মেধার মূল্যায়ন হয়নি। যারা নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ পান তাদের নিয়ে পাঠদানে অনীহা, মেধা প্রয়োগে অক্ষমতা, থিম নিয়ে কাজ করার অযোগ্যতা ইত্যাদি নানা সমস্যা দেখা দেয়।

আবার অতি মেধাবীদের এ সেক্টরে না আসার কারণ রয়েছে। আর্থিক সমস্যা, চাকরির গ্রেড, সামাজিক মর্যাদা সব মিলিয়ে একান্ত বাধ্য না হলে কেউ এই সেক্টরে চাকরি করেনা। শ্রেণীর হিসাব যখন ছিল সহকারী শিক্ষকদের বলা হতো ৪র্থ শ্রেণি আর প্রধান শিক্ষকদের ৩য় শ্রেণি।

বর্তমানে বেতন গ্রেড অনুসারে সহকারী শিক্ষকদের গ্রেড ১৩ আর প্রধান শিক্ষকদের ১১ তম ( ১০ গ্রেড সর্বত্র কার্যকর হয়নি)। অনেক অফিসের পিয়ন, দারোয়ান, ড্রাইভার এর চাইতে বেশী বেতন পেয়ে থাকে। যাদের বেতনের হাল এমন তাদের কাছে কতটুকু আশা করা যায়! এদের অবস্থা সেই সৈয়দ মুজতবা আলী'র " পন্ডিত মশাই" যুগেই রয়ে গিয়েছে। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের আকাশ ছোঁয়া দামের প্রেক্ষিতে একজন শিক্ষক নয় গোটা স্কুলের সবাই কুকুরের একটা ঠ্যাং এর সমান।

যদিও কিছুদিন যাবৎ পিএসসি’র মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, কিন্তু তাদের গ্রেড কি হবে সেই সমস্যার সমাধান হয়নি। চরম দুঃসময়ে অনেক মেধাবী ইচ্ছার বিরুদ্ধে যোগদান করলেও প্রথম সুযোগেই চাকরি পরিবর্তন করছে। আর থেকে গেলেও মনোযোগ দিতে পারছে না।

প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে না পারলে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। প্রথমেই কাঠামোতে হাত দিতে হবে। প্রাথমিক স্তর যেহেতু অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করার প্রস্তাবনা এসেছে, সেটাকে ভিত্তি হিসেবে ধরে নিতে হবে। শিক্ষার ভিত্তি দুর্বল হলে জাতির মেরুদণ্ডও দুর্বল হতে বাধ্য। পাঠ্যসূচি কি কি হবে তা শিক্ষাবিদগণ নির্ধারণ করবেন কিন্তু জাপান, কোরিয়া, ইউরোপ আমেরিকা কে আদর্শ ধরে করলে কাজ হবেনা বরং উন্নয়নশীল এবং সদ্য উন্নত বিশ্বে প্রবেশ করা দেশকে রোল মডেল ধরতে হবে।

শিক্ষকদেরচাকরির মর্যাদা ও বেতন কাঠামো উচ্চ স্তর তো বটেই, অতিরিক্ত সুবিধা দিতে হবে যেন মেধাবীরা আগ্রহী হন। শিক্ষার বাইরে অতিরিক্ত কাজে যখন তখন তাদের সম্পৃক্ত করা যাবে না। নির্বাচনী ডিউটি'র মতো জাতীয় ইস্যুতে তাদের সম্পৃক্ত করা হলেও বর্তমানে তাদের অতি নগন্য ভাতা প্রদান করা হয় যা অত্যন্ত লজ্জাজনক।

শিক্ষকদের গুনগত মান বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং করাতে হবে। পিটিআই কে আরও সুযোগ সুবিধা সম্বলিত আধুনিক মানের ট্রেনিং ও শিক্ষা গবেষণার জন্য উপযোগী করতে হবে।

পিএসসি’র মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ এবং তাদের স্কেল ১ম শ্রেণির হতে হবে। নিয়মিতভাবে যোগ্য ও উপযুক্তদের পদোন্নতি দিতে হবে।

শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক দিতে হবে। শ্রেণিকক্ষ ও বাহিরের পরিবেশ যেন শিক্ষাবান্ধব জয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

ম্যানেজিং কমিটি'র অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন কাউকে সভাপতি পদে আনা যাবে না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেবলমাত্র সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য যারা ম্যানেজিং কমিটিতে আসছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা শিক্ষা কার্যকমের সহায়ক না হয়ে বাঁধাগ্রস্ত করছে।

শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে। মন্ত্রণালয় ও ডিজি অফিসকে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে আগ্রহী হতে হবে।

এক সরকারের কার্যকরী পরিকল্পনা আরেক সরকার রাজনৈতিক কারণে যেন বাতিল না করে। প্রয়োজনে দল মত নির্বিশেষে সকলে মিলে শিক্ষা মান উন্নয়নে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে।

দেশ ও জাতির স্বার্থে শিক্ষার ভিত্তিমূল শক্ত করার জন্য পরিবার ও সমাজকে শিক্ষাবান্ধব ভুমিকা রাখতে হবে। শিক্ষার্থীর মেধার প্রকৃত বিকাশ ঘটে সেই দিকে সকলকে সচেষ্ট হতে হবে।

এসব চেষ্টার ফল পেতে কমপক্ষে এক জেনারেশন অপেক্ষা করতে হবে।

মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খান
মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খান
বিএ (সম্মান), এম এ, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্মী ও ফ্রি ল্যান্স লেখক।

সর্বশেষ

নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা

জনপ্রিয়

মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
নীতুর লিপস্টিক
নীতুর লিপস্টিক