বাংলাদেশ
পরীক্ষামূলক প্রচার
29-Jun-2024
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, নাই, গণতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া হবেও না
অরূপ রাহী
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, নাই, গণতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া হবেও না

১। ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ নিজেই একটা পরিবর্তনশীল ধারণা।

 ২। জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস- দর্শন চর্চার দেশ-কাল-পাত্র-রাজনীতি থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় সেই রাজনইতিক প্রকল্পের বাইরে থাকতে পারে না। 

৩। এনলাইটেন্মেন্ট প্রভাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ধারণা, তা ইতিমধ্যে পশিচমে ইন্তেকাল ফরমাইছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল নিয়ন্ত্রণ-পণ্যায়নের কারণে। 

৪। বিশ্ববিদ্যালয় 'আধুনিক' কালে সমাজ এবং রাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান। 

৫। কিন্তু উপনিবেশিত দেশে কি সেই বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভব, যা কি না এনলাইটেন্মেন্ট প্রভাবিত ‘মুক্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করার প্রতিস্ঠান’? হয়ত সম্ভব, জাতীয়তাবাদি চেতনায় যতটা সম্ভব, জাতীয়তাবাদি প্রকল্প যতটা অনুমোদন করে। 

৬। কিন্তু উপনিবেশ-উত্তর দেশ-রাষ্ট্রে? ততটা সম্ভব, যতটা জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম।

 ৭। উপনিবেশ-উত্তর প্রান্তিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে? ততটাই সম্ভব , যতটা বৈশ্বিক শ্রমবিভাজন এবং পুঞ্জির নিয়ন্ত্রণ অনুমোদন করে। 

৮। যেখানেই ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হয়, সেখানকার শর্তে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউটপিয়ান কোন ফরমুলায় হয় না। 

৯। নালন্দা বা মহাস্থানগড় বা সোমপুর বিহার ইউরোপিয়ান এনলাইটেন্মেন্ট প্রকল্পের ঘটনা না। কিন্তু এইগুলাও অই বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে বিকশিত ও বিল্পুত সামাজিক-রাজনইতিক-দার্শনিক - অনুশীলন। সেই অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় না। 

অইগুলাতে আবার সাইনবোর্ড লাগাইলে তা বর্তমানের বাস্তবতা অনুসারে ফাংশন করবে। অতীতের শর্তে নয়। 

১০। উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামের কালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। হয় নাই। কারণ জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম আগায় নাই। 

১১। আজকের উপনিবেশ অভিজ্ঞতার সমাজে, পুঞ্জি এবং জ্ঞানের নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণের কালে, জ্ঞান-বিজ্ঞান- সংস্কৃতির পণ্যায়নের এই বিশেষ ধরনের কালে, বাংলাদেশ কি বিশ্ববিদ্যালয় আছে? না। নাই। এই অর্থে নাই, যে, এমন কোন পাব্লিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নাই, যা এই দেশের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের সাথে যুক্ত। 

১২। হ্যাঁ , আছে। এই অর্থে আছে, যে এমন কিছু ;প্রতিষ্ঠান’ আছে, যা এই প্রান্তিক পুঞ্জিবাদী রাষ্ট্রের প্রান্তিক থাকা নিশ্চিত করায় ভূমিকা রাখে মাত্র। পণ্যায়িত শিক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা-লেনদেন-ব্যবহারে ভূমিকা রাখে। ফলে, ততটুকুই বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যতটা পুঁজির স্থানীয়- বৈশ্বিক শর্ত অনুমোদন করে। এই মাপের বাইরে যা আছে বা থাকে, তা হইল সমাজ- সংস্কৃতির উপস্থিতি- অই প্রতিষ্ঠানে। 

১৩। তার মানে, বিশ্ববিদ্যালয় বা মুক্ত জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার প্রতিষ্ঠান থাকা না থাকা আসলে গভীর ভাবে একটা সমাজ-রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিকতার মাত্রার উপর নির্ভর করে।

 ১৪। তার মানে, বাংলাদেশের মত দেশে বিশ্ববিদ্যালয় হবার সম্ভাবনা জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের সম্ভাবনার সাথেই যুক্ত। এর বাইরে থেকে, টাকা দিয়ে বা বিদেশি বিনিয়োগ করে বা সোমপুর বিহারে আবার সাইন বোর্ড টানিয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভব না। 

১৫। তাইলে কি আমাদের জ্ঞান চর্চা বলে কিছু নাই বা থাকবে না? অবশ্যই থাকে এবং থাকবে। যখন ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ ধারণার সৃষ্টি হয় নাই, তখনও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ছিল, যখন এই ধারণা বাতিল হয়ে যাবে বা আরো পরিবর্তিত হয়ে যাবে, তখনও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা থাকবে। সমাজ নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়। তার ভেতরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে বিশেষায়িত করাই ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প। এই প্রকল্প নিষ্কলুষ নয়। নয় সকল অবস্থায় গণতান্ত্রিক। বরং বিশেষায়িত জ্ঞানের বিশেষ নিয়ন্ত্রণ এবং তার বাণিজ্য 'মুক্ত' বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। 

১৭। ফলে, পুঁজিবাদের এইকালে পুঁজির নিয়ন্ত্রণে থেকে আর কোথাও, কখনও ইউটপিয়ার সেই বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তব রূপ নেবে না। বাংলাদেশেও না। বাংলাদেশে কোন বিশ্ববিদ্যালয় নাইও। 

১৬। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় নামে যা আছে, তার সাথে সমাজ-জাতির গণতান্ত্রিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বিন্দুমাত্র যোগাযোগ ঘটানো গেলে তাই হবে এই নামের স্বার্থকতা। 

১৮। স্থানীয়- বৈশ্বিক শ্রমবিভাজনে 'দক্ষ-অদক্ষ' 'শিক্ষিত'র সনদ দেয়া প্রতিষ্ঠানকে সনদ দেয়ার প্রতিষ্ঠান বলাই ভালো। ওসবের সাথে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সম্পর্ক নাই। 'বিশ্ববিদ্যালয়িক' জ্ঞান প্রকল্পের সম্পর্ক নাই। কিন্তু শিক্ষা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের গণতান্ত্রিক চর্চার ভবিষ্যৎ ভাবতে গেলে ভাবতে হবে জাতীয় এবং বৈশ্বিক মুক্তির সংগ্রামের কথা। সমাজের যে প্রতিষ্ঠান সেই কাজ করবে, তাই নতুন গণতান্ত্রিক বিদ্যালয়। তাই সমাজটাই বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বটাই বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বকে পুঁজি - জ্ঞান বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণের বাইরে আনার, একে গণতান্ত্রিক করার সংগ্রামটাই এই বিশেষ ঐতিহাসিক মুহুর্তে এর ছাত্র-শিক্ষকের কাজ।


 এই লিখার সাথে সূত্রগত সম্পর্ক নাই, কিন্তু পাঠকের কাজে লাগতে পারে, এমন কিছু বই/ লিখার লিঙ্কঃ The death of universities Terry Eagleton http://www.theguardian.com/commentisfree/2010/dec/17/death-universities-malaise-tuition-fees The Slow Death of the University By Terry Eagleton http://chronicle.com/article/The-Slow-Death-of-the/228991/ Ivan Illich: Deschooling Society https://en.wikiversity.org/wiki/Ivan_Illich:_Deschooling_Society Antonio Gramsci, schooling and education http://infed.org/mobi/antonio-gramsci-schooling-and-education/ On Education: Conversations with Riccardo Mazzeo Zygmunt Bauman http://as.wiley.com/WileyCDA/WileyTitle/productCd-0745661556,subjectCd-SO60.html ‘শিক্ষা’র রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি: কয়েকটি সংক্ষিপ্ত থিসিস ।। অরূপ রাহী FaceBook Note ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ আব্দুর রাজ্জাকের সাথে আলাপচারিতা। সরদার ফজলুল করিম grontho.com

অরূপ রাহী
অরূপ রাহী
অরূপ রাহী। জন্ম- ১৯৭৬। জন্মস্থানঃ পাবনা। কবি, সঙ্গীতশিল্পী, লেখক।

সর্বশেষ

নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা

জনপ্রিয়

মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
নীতুর লিপস্টিক
নীতুর লিপস্টিক