বাংলাদেশ
পরীক্ষামূলক প্রচার
03-Jul-2024
​ভাসানী: মৌলভী থেকে মজলুম জননেতা
আশানুর রহমান খোকন
​ভাসানী: মৌলভী থেকে মজলুম জননেতা

সন্তোষের বা সুসঙ্গের মহারাজার এক মুসলিম প্রজা কোরবানীর ঈদের সময়  আত্মীয় বাড়ী বেড়াতে যায়। ফেরার দিন তার আত্মীয়রা হাঁড়ি পাকানো গরুর মাংসের ছালুন তার বাড়ীর অন্যদের খাবার জন্য দিয়ে দেয়। সেই আধা সিদ্ধ গরুর মাংস বাড়ীতে এসে রান্না করতে শুরু করলে মাংসের ঘ্রাণ অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ে।

খবরটি শেষ পযর্ন্ত অভিযোগ অাকারে রাজ দরবারে পৌঁছায়। সেই সময় ঐ অঞ্চলে গো-হত্যা বা গো-মাংস খাওয়া এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল। নিষেধ অমান্য করায় অভিযুক্তকে তার বাড়ী থেকে ধরে আনা হয়। পাড়া-প্রতিবেশীরা সাক্ষী। অপরাধ স্বীকার করে নিতে হলো। বিচারে সাব্যস্ত হলো তাকে 'তক্তাডলা' দেয়া হবে। লোকটি সেই তক্তাডলায় মারা যায় অথবা প্রাণে বাঁচলেও পঙ্গু হয়ে যায়। এই খবরটি ছড়িয়ে পড়ে।

খবরটি পেয়ে এক মওলানা কাউকে কিছু না বলে পকেটে তজবিহ্, লুঙ্গি ও পান্জাবী গায়ে জায়নামাজ সাথে নিয়ে হাজির হলেন সন্তোষের রাণীগঞ্জে। সেদিন ছিল রাণীগঞ্জের হাটবার। পথে একজন টুপি পরা লোককে ঘটনাটির সত্যতা জানতে চাইলে সে কিছু বলতে অস্বীকার করে। মওলানার মেজাজ গরম হয়। বাজারে এক মুসলিম মহাজনের গদিতে সালাম দিয়ে ঢুকে পড়েন। তার কাছে ঘটনার সত্যতা জানতে চাইলে সে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নীচু স্বরে বলে, 'ঘটনাটি খুবই বেদনাদায়ক, তবে লোকটা বেকুব। যে দেশের যে নিয়ম সেটা সে মেনে চলবে না। কিন্তু কি করা যাবে বলুন?'

মওলানা তখন তার কথা শুনার আগ্রহ হারিয়ে যায়। তিনি জানতে চান, 'এখানে কোন ঢুলী পাওয়া যাবে? আমার একটি জরুরী জিনিষ ঘোষণা করা দরকার।’

ঢুলী এলে মওলানা তাকে ঘোষণার বিষয়বস্তু জানাতেই সে ক্ষেপে গেলো। বললো, ' বাড়ী কই? মরতে এসেছো? শালার মাথা খারাপ'। সব শুনে গদিওয়ালা মুসলিমটিও বলে উঠলো, ' আমার গদি ছাড়েন। ওসব বেফজুল আলাপ আমার এখানে না।’ 

অগত্যা মওলানা বের হয়ে এলেন। বাজারের ভুসিমালের দোকান থেকে চার আনা দিয়ে খালি গুড়ের টিন কিনলেন। তারপর একটি লাঠি কুঁড়িয়ে নিয়ে নিজেই টিন বাজিয়ে তার বক্তব্য বলে গেলেন। কেউ শুনল, কেউ শুনলো না। তখন সন্ধা হয়ে আসছে। তিনি অন্ধকারে গা-ঢাকা দিলেন। কানে ভেসে আসলো কেউ কেউ বলছে, 'কই গেল? মাথা খারাপ। ধর, ধর।’

রাণীগঞ্জ বাজার থেকে একটি দূরে একটি মসজিদওয়ালা বাড়ীতে মোসাফির হিসাবে আশ্রয় নিলেন। রাতে হাটফেরা লোকজনের মুখে মুখে বাজারের ঘটনা গ্রামের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো। সেই মসজিদে রাতে এশার নামাজ পড়তে আসা কিছু মানুষও একই আলাপ করতে থাকলো। লোকটা দেখতে কেমন, কোত্থেকে এসেছে?

মওলানাকে দেখে একজন বলে উঠলো, ' সেই লোকটি তো এনার মতোই দেখতে'। এবার মওলানা বললেন, ' শুনেন ভাইসব! আপনারা যদি সাচ্চা আল্লাহর বান্দা ও নবীর উম্মত হন, পবিত্র কোরান ও হাদিসে বিশ্বাসী হন, তাহলে সাচ্চা মুসলিম হিসাবে ঈমান পরীক্ষার সময় আজ এসেছে। এই ঢোল আমিই পিটিয়েছি এবং ইনশাল্লাহ্ এখানে গরু জবাই ও জিয়াফত হবেই হবে।

উল্লেখ্য যে মওলানা রাণীগঞ্জ বাজারে টিন পিটিয়ে বলেছিলেন, ' আগামী কোরবানীর ঈদে ৫০০ গরু জবাই দিয়ে তিনি সকলকে জিয়াফত খাওয়াবেন, এটাই হবে জালেম জমিদারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ। আপনারা আমার দাওয়াত কবুল করেন এবং অন্যদেরকেও আমার দাওয়াত পৌঁছে দিন। আপনারা যদি আমার এই দাওয়াত কবুল না করেন তবে হাশরের ময়দানে আমি আপনাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবো।’

গরীব মোল্লা জিয়াফত তো দিলেন। তিনি গরু পাবেন কোথায়? চাল, পেঁয়াজ ও অন্যান্য জিনিষ? এলাকার মানুষই বা তার দাওয়াত নেবেন কেন? তিনি কয়েক মাস ধরে গ্রামে গ্রামে ছুটলেন। দাওয়াত দিতে থাকলেন। ধনী মুসলিমদেরকে অর্থ সাহায্য, যাকাত দিতে বললেন। গরীব মুসলিমদেরকে একমুঠো চাল, একটি ঝাল, একটি পিয়াজ সাথে নিয়ে আসতে বললেন। দাওয়াত ছড়িয়ে গেলো। মওলানার নামে হুলিয়া জারি হলো সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেবার অভিযোগে। নির্দিষ্ট দিনে জিয়াফত ঠেকাতে দু'ডজন গোর্খা পুলিশ এলো। হাজার হাজার মানুষের পদভারে রাণীগঞ্জ মুখরিত হলো।

ভয় পেয়ে পুলিশ গেলো জমিদার বাড়ী। সেদিন ৫০০ নয়, গরু কোরবানী হয়েছিল এক হাজারের উপর। কিছু উগ্র লোক গরু জবাই দিতে চাইলো জমিদারের বাড়ীতে। তিনি কঠোরভাবে বাধা দিলেন। তিনি বললেন, 'আমরা জুলুমের প্রতিবাদ করতে এসেছি, অন্যের ধর্ম নষ্ট করতে নয়'। হাজার হাজার জনতার শ্লোগানে মুখরিত দিগন্ত। মওলানা আব্দুল হামিদ, জিন্দাবাদ! রাণীগঞ্জের খবরটি দৈনিক পত্রিকায় শিরোনাম হয়ে গেলো। মওলানার নাম জানলো দেশবাসী, কলকতার নেতারাও।

দৈনিক আজাদ সম্পাদক মওলানা আকরাম খাঁন 'মওলানা'কে কলকাতায় যাবার আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি কলকাতা যাবেন কিন্তু উঠবেন কোথায়? এক হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বললেন বে-কার হোস্টেলে উঠতে। তিনি কলকাতার কাজ সেরে কয়েকদিন হোস্টেলে থেকে গেলেন। সেখানেই অল্পবয়সী ছেলে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মোখলেছুরের সাথে পরিচয় হয়। মওলানা যেদিন ঠিক করলেন ফিরে যাবেন আসামে, সেদিনই মোখলেছুর তার সাথে পরিচিত হয়ে অনুরোধ করলেন থেকে যেতে। কারণ সে মওলানার সাথে জরুরী কিছু বিষয়ে কথা বলতে চায়।

মওলানা রাজী হলে পরের দিন সকালে মওলানাকে নিয়ে ছেলেটি গিয়ে বসলেন গড়ের মাঠে। প্রথমেই ছেলেটি বললেন, ' আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। আমার কথার মাঝখানে আপনি কোন কথা বলবেন না। আপনার কথা বা প্রশ্ন থাকলে, আমার কথা শেষ হবার পর বলবেন।’ 

মওলানা রাজী হলেন। ছেলেটি বললো, ' রাণীগঞ্জে আপনি যা করেছেন সেটা যদি for the cause of muslims হয়, ইতিহাসে আপনি এক ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক নেতা হিসাবে পরিচিত হবেন। আর এই কাজটিকে যদি আপনি দুর্বলের উপর সকল অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদ হিসাবে দেখেন অথবা কারো জন্মগত বা ধর্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠার ইস্যু হিসাবে দেখেন, ইতিহাসে আপনি একজন বিজয়ী মজলুম নেতা হিসাবে পরিচিতি পাবেন। ইতিহাসে আপনি নিজেকে কিভাবে পরিচিত করাবেন? সিদ্ধান্ত আপনার। আপনার যে পরিমাণ কাজ করার ক্ষমতা আছে তেমনই আছে অদম্য সাহস ও মনোবল। আপনি আপনার মনোবলের পরিচয় দিয়ে দেশবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেই অপরিসীম ক্ষমতার আপনি অপচয় করে চলেছেন। এটাই আফসোস।’

তার এই কথায় মওলানা আত্ম-অহমিকায় বেশ একটা ঘা লাগলো কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। ছেলেটি বলে চললো, ' সমাজে ধর্মভ্রষ্টদের হেদায়েত করার, ধর্ম শিক্ষা দেবার লোকের অভাব নেই। পরকাল পরিত্রাণের পথনির্দেশ তারাই করবেন। আপনি আপনার অনন্য ক্ষমতাকে মানুষের ইহকালের পথ নির্দেশের শপথ নিয়ে পথে নামুন। ইসলাম তো ইহকাল-পরকালের একটি জীবন বিধান। ইহকাল আগে আর পরকাল পরে। কাজেই ইহকালে যারা দুঃখ কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে তাদের পরিত্রাণ করা আপনার আশু কর্তব্য। বলুন, আমার প্রস্তাবে রাজী কিনা?'

মওলানা বললেন, 'ইনশাল্লাহ্, আমি প্রস্তুত'।

ছেলেটি বললো, ' মারহাবা। তাহলে এই সব বাহুল্য কাজ ছেড়ে দিয়ে আপনাকে সঠিক কর্মক্ষেত্র ও পদ্ধতিগত কাজ করার সংকল্প নিতে হবে।’

মওলানা রাজী হলে ছেলেটি বললো, ' তাহলে ওয়াদা করুন, আমি আপনাকে কর্মক্ষেত্র যা নির্দেশ করবো সেটা বিনা প্রশ্নে তামিল করবেন।'

মওলানা ওয়াদা করলে পরের দিন সাড়ে সাতটা ট্রেন ধরার জন্য মওলানাকে প্রস্তুত থাকতে বলা হলো।

মওলানা ফজরের নামাজ পড়ে, সকালের নাস্তা সেরে মোখলেছুরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আজ সকাল সাড়ে সাতটায় তাদেের বেরিয়ে পড়ার কথা। সাড়ে সাতটা বেজে গেল, তার কোন খোঁজ নেই। সময় আরো বেড়ে যাচ্ছে তার কোন খবর নেই। মওলানা ভাবলেন এরকম একটি ছেলের কথায় হুট করে কিছু করতে চাওয়া উচিত হয়নি। তিনি ভাবলেন, দুপুরের ট্রেনে তিনি আসামের পথ ধরবেন। এমন সময় হুড়মুড় করে ছেলেটি ঘরে ঢুকেই বললো, 'মওলানা, আপনি তৈরী? চলুন বেড়িয়ে পড়ি, নাহলে ট্রেন ধরাই মুশকিল।'

মওলানা ভাবলেন না করে দেবেন। আবার ভাবলেন কোন কর্মক্ষেত্র সে দেখাতে চায়, না দেখেই বা কিভাবে ফিরি। স্টেশনে পৌঁছানোর কিছুক্ষণবাদেই ট্রেনটি ছেড়ে দিলো। মওলানা জানেন না কোথায় নামতে হবে। জানতে চাওয়াও বারণ। দুপুরের দিকে একটি মফস্বল শহরের স্টেশনে তারা নামলেন। শহরের শেষ মাথায় একটি সস্তা হোটেলে গিয়ে তারা উঠলেন। হোটেলটি অত্যন্ত নোংরা। মওলানার গা ঘিন ঘিন করছিল। ছেলেটি হোটেলওয়ালাকে বলে গেল ইনাকে অজুর পানি দেবেন, গোছল করতে চাইলে ঘাটটি দেখিয়ে দেবেন। ভাল খাবার ও পরিষ্কার বিছানার চাদর দিতেও বলে ছেলেটি বের হয়ে গেল।

মওলানা মাগরেবের নফল নামাজ শেষ করে সালাম ফিরাতেই দেখে ছেলেটি এসেছে। বললো, 'এখনও কিছু খাইনি, পেট চোঁ চোঁ করছে। কিছু খেয়ে নেই। আপনি সব গুছিয়ে নিন। খেয়েই রওনা হবো।’

মওলানা ভাবলেন এবার বোধকরি অন্য কোন স্টেশনে যেতে হবে। হোটেলের পাওনা মিটিয়ে সেই সন্ধায় তারা বেরিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ বাদে মওলানা খেয়াল করলেন তারা স্টেশনের দিকে নয়, যাচ্ছেন অন্য কোথাও। মওলানার মনে প্রশ্ন কিন্তু জানতে চাওয়া বারণ। অগত্যা তার পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকলেন। আবছা অন্ধকারে বহুদূর গ্রামের দিকে পায়েচলা মেঠো পথ ধরে তারা এগিয়ে চললেন।

দু/আড়াই ঘণ্টা একনাগাড়ে হাঁটার পর যখন তিনি হাঁফিয়ে উঠেছেন তখন মোখলেচুর পায়ে হাঁটা পথ ছেড়ে লাঙল চলা ক্ষেতের মাঝ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। চৈত্রের শুকনো শক্ত মাটির ঢেলা মাড়িয়ে চলতে মওলানার কষ্ট হচ্ছিল এবং প্রায়ই হোঁচট খাচ্ছিলেন। ছেলেটি মওলানার তকলিফের কোন তোয়াক্কাই করছিল না। এভাবে আরো ক্রোশখানিক পথ চলার পর দু'জনের গতি থামলো। সামনে একটি জঙ্গল। ডানে-বায়ে ঘুরে সে জঙ্গলে ঢুতার পথ ঠাহর করে আবার হাঁটতে শুরু করলো। মওলানা ভাবছেন এই ছেলে ছোকরার খপ্পরে পড়ে কি মুসিবতেই না পা বাড়িয়েছেন।

জঙ্গলের মাঝখানে একটি খোলা জায়গা পেয়ে তারা এসে থামলো। ছেলেটি আস্তে করে বললো, ' বসুন, খানিকটা বিশ্রাম নেয়া যাক। আপনার খুব কষ্ট হয়েছে।’

মওলানা সৌজন্যের খাতিরে না বললেন। জেনে নিলেন, পশ্চিম কোনদিকে। তিনি এশার নামাজ পড়লেন। ছেলেটি তার ব্যাগ থেকে চিড়া, গুড় আর কলা বের করলেন। অনেকক্ষণ ধরে চিড়া চিবিয়ে, বোতলে করে আনা পানি খেয়ে তারা আবার হাঁটতে শুরু করলেন। জঙ্গল ছেড়ে তারা গ্রামে ঢুকলো। রাত গভীর। মাঝে মাঝে রিজিক তল্লাশি শেয়ালের কোরাস শোনা যাচ্ছে। গ্রামের যে পাড়ায় তারা ঢুকলেন পাড়া জুড়ে সারি সারি দালানকোঠা। এরকম একটি বাড়ীর উঠোনে গিয়ে তারা থামলো।

ঝোলা ব্যাগ থেকে ছেলেটি একটি বোতল বের করে গন্ধ শুঁকে মওলানার হাতে দিলো। গন্ধ শুঁকে মওলানার আক্কেলগুড়ুম। মওলানার বোতলধরা হাত দুটি ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে সে চাপা গলায় বললে, ' ছড়িয়ে দিন, ছড়িয়ে দিন'। মওলানার তখন নিজস্বতা বলতে কিছু নেই। সম্মোহন মন্ত্রে যেন তিনি বশীভূত। ছড়িয়ে দিলেন পেট্রোল। ছেলেটি একটি দিয়াশলাই বের করে তার হাতে দিয়ে বললেন, ' ঠুকে দিন'। মওলানার হাত তখন আড়ষ্ট। মওলানার দু'হাত ধরে সে নিজেই কাঠিটি জ্বালিয়ে বললো, ' ছুঁড়ে মারুন। ছুঁড়ে মারুন।’ 

মওলানার চিন্তা, চেতনা, বিবেক যেন লোপ পেয়েছে। আবারো মন্ত্র বশীভূতের মতো তিনি ছুঁড়ে দিলেন। পেট্রোলের গন্ধ পেয়ে আগুন যেন বাতাসের আগে ছড়িয়ে যেতে লাগলো। মওলানা হতভম্বের মতো স্তব্ধ হয়ে দেখছিল আগুনের লেলিহান শিখা। ছেলেটির হেঁচকা টানে তিনি সম্বিৎ ফিরে পেলেন।

ছেলেটি বললো, ' দেখছেন কি? বাঁচতে চাইলে পালান'। মওলানার হাত ধরে তারা জঙ্গলের দিকে ছুঁটতে থাকলেন। জঙ্গলের সেই ফাঁকা জায়গায় আসতেই মওলানা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ' মোখলেছুর, তুমি আমাকে দিয়ে একি করালে?' সে ধমক দিয়ে উঠলো, ' চুপ করুন। জানে বাঁচতে চান? একটি কথা বলবেন না। শুনতে পাচ্ছেন না, চারিদিক থেকে লোকজন ছুটে আসছে?

তারা আবার চলতে শুরু করলেন। মওলানা মনে মনে এই ভয়ানক পাপের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা চাচ্ছিলেন। সারাপথ তিনি মনে মনে দগ্ধ হতে থাকলেন। এবার তারা অন্য একটি হোটেলে উঠলেন। আগের মতোই হোটেলওয়ালাকে মওলানার খোঁজ খবর নেবার কথা বলে চলে গেলো।

হোটেলে পৌঁছাতে বেলা হয়ে গিয়েছিল। মওলানা ফজরের ক্বাযা নামাজ পড়তে বসে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। গতরাতের নির্ঘুম ও ক্লান্তির কারণে তিনি সিজদারত অবস্থায় ঘুমিয়ে গেলেন। জোহরের নামাজের কিছু আগে ঘুম ভাঙলে তিনি কিছু খেয়ে, নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙলো একেবারে বিকাল বেলায়। ছেলেটি ফিরেছে কিনা জানতে চাইলে হোটেল বয় জানায় সে ফেরেনি। ছেলেটার সব কাজই এখন তার কাছে রহস্যময় মনে হচ্ছে। নিজেকে এই কাজে যুক্ত করে মনে মনে তিনি অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকলেন। বাদ মাগরিব সে ফিরে এলো। এসে মহা উল্লাসে মওলানার পা ধরে কদমবুচি করে আবৃত্তি করে উঠলো, 'কামাল তুনে কামাল কিয়া হ্যায়'।

মওলানা হা করে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। সে বললো, ' আপনাকে জবর একটি খবর শোনাবো। চলুন একটু বাইরে ঘুরে আসি। হাঁটতে হাঁটতে বলবো'। আবার অজানা আশংকায় মওলানার মনে হচ্ছিল বাহানা করে তাকে কাটিয়ে দেয়। অনিচ্ছা সত্বেও তিনি তার সাথে বের হলেন। গিয়ে বসলেন স্থানীয় স্কুল মাঠে। মোখলেছুর বক্তৃতার ঢঙে বললো, ' মওলানা সাহেব, আপনি কি জানেন আজ এত বছর ধরে ওয়াজ-নসিহত করে করে এই হতভাগ্য সমাজের প্রত্যক্ষ যে উপকার করতে পারেননি, অথচ গত রাতে একটি দিয়াশলাইয়ের কাঠির সাহায্যে একসাথে দু'হাজার কষ্ট-ক্লিষ্ট মানুষের মুসিবত মুক্ত করতে পেরেছেন। এই মাত্র থানার এজাহার থেকে জেনে এলাম গতকালের অগ্নিকান্ডে দেড় লক্ষের উপর রোকটাকা পুড়েছে, পুড়েছে চুয়ান্ন হাজার টাকার সুদী লগ্নির তমসুক। বছেরর পর পর বছর ধরে যারা শোষিত ও নির্যাতিত হচ্ছে তাদেরকে আপনি রেহাই দিলেন এক নিমিষে।'

তার কণ্ঠে এমন দরদ ছিল, আবেগ ছিল যে গতকাল থেকে মওলানার মনে যে পাপ, অপরাধরোধ কাজ করছিল তা একটু একটু করে কেটে যেতে লাগলো। মনে হলো ময়ালের এই গরীব, আধাপেটা মানুষগুলো বোধকরি তারই অপেক্ষায় ছিল। তারা আরো দু'দিন থেকে গেলো। চেষ্টা করলো স্থানীয় মানুষের মনোভাব বুঝার। মখলেছুর তার স্থানীয় সহকর্মীদের কিছু কাজের ভার দিলো। সে যাত্রা সেই 'ময়াল' জায়গাটি ছেড়ে এলেও তারা সেই ময়ালকে কেন্দ্র করে এক গোপন কর্মঘাটি গড়ে তোলেন। এভাবে স্থানীয় সঙ্গবদ্ধ কর্মীদের দিয়ে তারা শুরু করেন কুসিদজীবী মহাজন ও মধ্যস্বত্বভোগীদের সাথে নিম্নমধ্যবিত্ত ও বিত্তহীনদের চোরাগুপ্তা সংগ্রাম।

বাংলা ৩০ শে চৈত্র জমিদার ও মহাজনরা পাওনা আদায়ে তামাদীর মামলা করে থাকেন। এ সময় নায়েব-গোমস্তরা দলিল তমসুকের বস্তা নিয়ে সদরে যেত। মওলানাদের ঐ সব কর্মীরা অতর্কিতে হামলা চালিয়ে তাদের সামনেই ঐ সব দলিলে আগুন দিত। পরবর্তীতে 'প্রজাস্বত্ব আইন'টি পাশের ক্ষেত্রে তাদের সেই সব কর্মকান্ডের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল।

এভাবেই মওলানা ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরী করলেন মজলুম জননেতা হিসাবে। তাঁর খুব পছন্দের একটি ফার্সি বয়ান ছিল। যেটা লেখা আছে শায়খ আবুল হাসান খেরকানীর মাজারে। তিনি প্রায় সেটা বলতেন। " আমার দরগায় যেই আসবে তাকে রুটি দিও। তার বিশ্বাস বা আচার কি তা জিজ্ঞাসা করো না। কারণ আমার প্রভুর কাছে যার জীবনের মূল্য আছে, তার তুলনায় আমার রুটির মূল্য অতি নগন্য ও তুচ্ছ"। মওলানা, আমরা আপনার প্রতিক্ষায় আছি! আরেকবার বাংলায় ফিরে এসে বলুন, ' খামোশ!'

তথ্যসূত্র: দেওয়ান গোলাম মোর্তজার 'ভাসানী জীবনের অলিখিত অধ্যায়

আশানুর রহমান খোকন
আশানুর রহমান খোকন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, পেশায় ব্যাংকার

সর্বশেষ

নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
নারীর অধিকার কোন পণ্য নয়, প্রিয় ফ্লোরা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
রাবেয়া বশরীর একগুচ্ছ কবিতা
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
মেয়েটি আমার মাথায় চা ঢেলে দিতে লাগল
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
​একটা খেঁজুর গাছের শাহাদাত ও পয়লা বৈশাখ
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
কাউয়া বেশি, শিন্নি কম
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
দুপুর মিত্রের উপপাদ্য
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
কাল্পনিক নাটক : ব্যাংকু
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
​৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষাপট
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য: মিলগ্রামের পরীক্ষা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা
তাসনীম খলিলের ভারতপন্থা

জনপ্রিয়

মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
মঙ্গার বাইরেও গাইবান্ধার একটা পরিচয় আছে
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
ইডেনে ছাত্রলীগের যৌন রাজনীতি এবং একজন সুলতানা কামাল
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়া প্রশ্ন ওঠা শুরু হইছে
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
ভালোর বাসায় পুঁজির ডিম
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
সানজিদা আমীর ইনিসীর কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
মজনু শাহ’র দুটি কবিতা
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
বাংলাদেশের বেশির ভাগ দুর্ভাগ্যের জন্য বামেরা দায়ী
নীতুর লিপস্টিক
নীতুর লিপস্টিক