আইসিটি খাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম, অপচয় হাজার হাজার কোটি টাকা।
গত দেড় দশকে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম ও অপচয়ের চিত্র উঠে এসেছে তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গঠিত ১২ সদস্যের এ কমিটি আইসিটি বিভাগের আওতাধীন ২১টি প্রকল্প পর্যালোচনা করে জানায়—প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ১৯ হাজার ২০ কোটি টাকা ।
কমিটির
ভাষ্যমতে, একাধিক প্রকল্পে অতিরিক্ত ভবন নির্মাণ, অপ্রয়োজনীয়
জমি অধিগ্রহণ, বাস্তবতাবর্জিত প্রশিক্ষণ ও সফটওয়্যার ক্রয়সহ
নানা খাতে অনেক অপচয়
ঘটেছে।
অতিরিক্ত
ভবন ও জমিতে কোটি টাকার অপচয়
‘আইটি
ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার
স্থাপন (২য় সংশোধনী)’ প্রকল্পে
আটটি জেলায় ছয়তলা ভবন নির্মাণ করা
হয়, যেখানে দোতলা ভবনই যথেষ্ট ছিল।
এতে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে প্রায়
১১০ কোটি টাকা। একই প্রকল্পে
অপ্রয়োজনীয়ভাবে এক থেকে পাঁচ
একর পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণ করায়
খরচ বেড়েছে ১৩ কোটি টাকা।
একই
ধরনের আরেক প্রকল্পে, ১৪
জেলায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণে পাঁচটি উপজেলা সদর নির্বাচন করা
হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়, যা প্রকল্পের যৌক্তিকতা
নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এ প্রকল্পে অতিরিক্ত
জমি ও সাততলা ভবন
নির্মাণে ৪৭৮ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে।
'হাসিনা
অ্যান্ড ফ্রেন্ডস' ওয়েবসাইটে ২০ কোটি টাকা
২০১৬
সালে শুরু হওয়া ‘উদ্ভাবন
ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি (আইডিয়া)’ প্রকল্পে তৈরি করা হয়
‘হাসিনা অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ নামের একটি ওয়েবসাইট, যার
জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা। বর্তমানে সাইটটি
বন্ধ এবং এর কার্যকারিতা
নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
গেম-অ্যাপস তৈরি, নেই ব্যবহার
৩৩০
কোটি টাকার ‘মোবাইল গেম ও অ্যাপস
উন্নয়ন’ প্রকল্পে তৈরি হয় ১৬৪টি
গেম ও ১০২টি অ্যাপস।
তবে এগুলোর কার্যকারিতা নেই বললেই চলে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এই
প্রকল্পে ১৪৬ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। অধিকাংশ
কাজই বেসরকারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করায় উদ্ভাবনের নামে
প্রকৃতপক্ষে কোনো অর্জন হয়নি।
আরও
প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয়
২০১৯
সালের একটি প্রকল্পে সফটওয়্যার
কেনাকাটায় ১৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে।
২০২২ সালে নেওয়া ‘ডিজিটাল
অর্থনীতি’ প্রকল্পে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শক খাতে
১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ের যৌক্তিকতাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
৫ হাজার ৯২৩ কোটি টাকার
‘ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন’ প্রকল্পে চীনের সঙ্গে ঋণচুক্তি ছাড়াই কাজ শুরু করা
হয়েছে। তদন্ত কমিটির মতে, প্রকৃত প্রয়োজন
বিবেচনায় এই প্রকল্পে ৪
হাজার ৭৫ কোটি টাকা অপচয় হওয়ার শঙ্কা
রয়েছে।
অপ্রয়োজনীয়
আইটি পার্ক ও ভবিষ্যতের ঝুঁকি
১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকার
আইটি পার্ক প্রকল্পে অন্তত চারটি পার্ক অপ্রয়োজনীয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে কমিটি। সেগুলো বাতিল করলে ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব। একইভাবে, মাদারীপুরের শিবচরে নির্মাণাধীন ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি’
প্রকল্পেও অপ্রয়োজনীয় জমি ও ভবন
নির্মাণে ৫০ কোটি টাকার অপচয় হয়েছে।
টিআইবি’র মন্তব্য
ট্রান্সপারেন্সি
ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,
“ডিজিটাল বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশের স্লোগানের আড়ালে গত ১৫ বছরে আইসিটি খাতে নানা রকমের লুটপাট হয়েছে। প্রকল্প পরিকল্পনাকারীদের জবাবদিহির আওতায় না আনলে ভবিষ্যতেও দুর্নীতির ঝুঁকি থেকে যাবে।”
তদন্ত
প্রতিবেদন বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে বাস্তবতা ও প্রয়োজন বিবেচনা
না করায় বিপুল অর্থের
অপচয় হয়েছে। ভবিষ্যতে এমন অনিয়ম রোধে
সুপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের
জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।