বুধবার, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৫
১৯ ভাদ্র ১৪৩২

আপনি পড়ছেন : সাক্ষাৎকার

আমাদের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র বেশি দিন আর টিকবে না


নাহার বীথি ১০ আগস্ট ২০২৫, সন্ধ্যা ৬:০০
আমাদের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র বেশি দিন আর টিকবে না
কাজী মারুফুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক

কাজী মারুফুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক। শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও জননীতি তাঁর গবেষণার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের এই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান, সংস্কার, নির্বাচন, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেছেন।


ভূমিপুত্র: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর হতে চলল। গত বছর এ অভ্যুত্থানের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে সেই দিনগুলোকে এখন কীভাবে স্মরণ করবেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: সেই সময়টা আসলে অন্য রকম ছিল। যখন সারা দেশে নিষ্ঠুরভাবে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন-খুন করা হচ্ছিল, তখন তাদের পাশে না দাঁড়ানোর আর কোনো সুযোগ ছিল না। ওরা তো আমাদেরই সন্তান। আসলে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোই শিক্ষকের চিরায়ত ধর্ম। বাংলাদেশে অনেক উদাহরণ আছে। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুজ্জোহা। এই যে মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় দুজন শিক্ষক, তাঁরা কিন্তু বেঁচে যেতে পারতেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ দিতেও দ্বিধা করলেন না। তাঁদের কথা ভাবলে মনে হয়, আমরা আসলে কিছুই করিনি।

চব্বিশের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টার তিনটি দিক আছে—একজন মানুষ হিসেবে, একজন শিক্ষক হিসেবে ও একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব। চব্বিশের জুলাইয়ে আমি ও আমাদের যে সহকর্মীরা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, আমার মনে হয়, তাঁরা এই তিন বিবেচনা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তখন আসলে আমরা বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, জুলাই আমার জীবনের অনন্য এক অধ্যায়। এক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে পারার সংগ্রামের অংশ হওয়া আমার কাছে সত্যিই খুব গৌরবের।


ভূমিপুত্র

এক বছর পরে এসে গণ-অভ্যুত্থান কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এর মূল চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য কী ছিল বলে মনে করেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান একটা বহু বর্ণের, বহু মাত্রার, বহু স্বার্থের বিবিধ অংশীজনের সম্মিলনে একধরনের গণবিস্ফোরণ। এ দেশের ইতিহাসে গণ-অভ্যুত্থান নতুন নয়। তবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি শুধু একটি সরকারের পতন নয়, বরং একটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস।

এই অভ্যুত্থান নিছক একটি ছাত্র আন্দোলনের ফল নয়, এটি ছিল দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ, বঞ্চনা ও রাজনৈতিক বন্ধ্যত্বের বিরুদ্ধে এক অভাবনীয় গণজাগরণ। এটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি একাধারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং বিদ্যমান শাসনকাঠামোর প্রকৃতি ও বৈধতা নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন তুলেছে। এর বিশিষ্টতা ছিল নাগরিকের অধিকার, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধরন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা।

খেয়াল করুন, এ আন্দোলনের কোনো একক নেতা ছিলেন না। কোনো একক ব্যক্তি বা সংগঠন এ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়নি। এ আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এর বিকেন্দ্রীকৃত নেতৃত্ব; একক নেতা বা দলনির্ভরতা নয়, বরং অনেকগুলো উদীয়মান রাজনৈতিক স্বর ও পক্ষ এই আন্দোলনে অংশ নেয়। এটি একটি বিস্তারযোগ্য, বিকেন্দ্রীকৃত, নেটওয়ার্কভিত্তিক নেতৃত্বের কাঠামো দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। শহর থেকে গ্রাম, ক্যাম্পাস থেকে কারখানা—সর্বত্র একধরনের সমান্তরাল নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, যা আগের কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে দেখা যায়নি।

দ্বিতীয়ত, এ আন্দোলনের একক লক্ষ্য বা স্পষ্টভাবে ঘোষিত কোনো চূড়ান্ত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন স্তরে অংশগ্রহণকারীরা ভিন্ন ভিন্ন দাবি ও প্রত্যাশা নিয়ে যুক্ত হয়েছিলেন।

তৃতীয়ত, কোনো প্রচলিত রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল না। এ আন্দোলন প্রমাণ করেছে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জনগণের আত্মশক্তি কোনো রাজনৈতিক দল ছাড়াও সংগঠিত হতে পারে।

চতুর্থত, তরুণ নেতৃত্ব এই আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি ছিল। আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র–ছাত্রী, শ্রমিক ও শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। তাঁদের বয়স ছিল মূলত বিশের কোঠার শুরুর দিকে থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বে এগিয়ে এসেছেন।

পঞ্চমত, এই বিদ্রোহ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস ও জাতিসত্তার মেটা-ন্যারেটিভকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পরিচয় ও জাতিসত্তা নিয়ে প্রচলিত বয়ানের বাইরে এসে এই বিদ্রোহ জনগণের সার্বভৌমত্বের একটি ন্যায্য ব্যাখ্যা সামনে এনেছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই আন্দোলনে নারীদের অসাধারণ ও বৈপ্লবিক ভূমিকা। হাজার হাজার নারী শুধু উপস্থিতই থাকেননি, নেতৃত্বও দিয়েছেন। তাঁরা কৌশল নির্ধারণ, ফ্রন্টলাইনে থেকে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ, আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে সমন্বয় পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন।


ভূমিপুত্র:

গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা-প্রাপ্তি-সাফল্য-সীমাবদ্ধতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতিতে এটা কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে?

কাজী মারুফুল ইসলাম: গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য তো আছেই। এখনকার পরিস্থিতি আমাকে সত্যিই বিষণ্ন করে। কিন্তু আমি এটাও মনে করি যে এই অভ্যুত্থানের ফলাফল নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো হয়নি।

এই অভ্যুত্থানের হাত ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে মাত্র। অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হবে। তবে এটা সামনের দিকেই এগোবে। একটা উদাহরণ দিই, আমাদের রাজনীতিতে প্রচলিত যে পরিবারতন্ত্র আছে, এটা আর বেশিদিন টিকবে না। এই অভ্যুত্থান রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে।


ভূমিপুত্র:

গণ–অভ্যুত্থানের পর অংশীজনদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে বলে অনেকে দাবি করছেন। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে এ ধারণাকে ব্যাখ্যা করছেন। এই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রায়োগিক সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক রূপ আসলে কেমন বলে আপনি মনে করেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: আমার কাছে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হলো, ক্ষমতার নতুন বিন্যাস। অর্থাৎ ক্ষমতার পুরোনো কেন্দ্র যেমন রাজনৈতিক দল, সংসদ, বিচার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্থানীয় সরকার, আমলাতন্ত্র, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, গণমাধ্যম—এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং একই সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালনে উপযোগী সক্ষমতা গড়ে তোলা।

একটা উদহারণ হতে পারে যে সংসদের ক্ষমতা ভেঙে এক কেন্দ্রের জায়গায় একাধিক কেন্দ্র স্থাপন করা, যাকে আমরা ‘বাই ক্যামেরাল’ সংসদের কথা বলছি; ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিবর্তনে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে কোনো নির্দিষ্ট বিনিয়োগকারীদের হাত থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা; পুলিশের বর্তমান কাঠামো ভেঙে একটি স্বাধীন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আনা—এগুলো হতে পারে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার প্রায়োগিক জায়গা।

একটি গণতান্ত্রিক অর্থনীতি, অর্থাৎ সবার জন্য প্রতিযোগিতার সমান সুযোগ আছে; স্বচ্ছ, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত, মালিক ও শ্রমিক-—উভয়ের অধিকার আছে, এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টি নতুন বন্দোবস্তের অংশ।

ভূমিপুত্র:

নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা হচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে আপনি কী ধরনের চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকি দেখছেন?


কাজী মারুফুল ইসলাম: অন্তর্বর্তী সরকার অনেকগুলো কারণে নিজেদের কর্তৃত্বের কার্যকর ব্যবহার করতে পারেনি। এ কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে একটা জাতীয় নির্বাচন অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হতে গেলে যে পরিস্থিতি থাকা দরকার, তা এই মুহূর্তে ঠিক কতটা আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

এর মূল কারণ, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এত আলোচনার পরও পরস্পরের প্রতি আস্থার জায়গা যথেষ্ট শক্ত নয়। এখনো মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ আছে। তৃণমূল পর্যায়ে প্রচুর অস্ত্র ও অবৈধ টাকার উপস্থিতি রয়ে গেছে, যা নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে ব্যবহৃত হতে পারে।

আমার মতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা, সিভিল প্রশাসনের সহযোগিতা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ঐকমত্য, নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ ও শক্ত ভূমিকা দরকার। এর যেকোনো একটির অনুপস্থিতি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।


ভূমিপুত্র: 

বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধাগুলো আসলে কী?

কাজী মারুফুল ইসলাম: এই সময়ের প্রধান সমস্যা হলো রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিকড় গেড়ে থাকা গোষ্ঠীতন্ত্র। অলিগার্কদের চক্র এখনো অনেক শক্তিশালী। এই সময়ে আমাদের অন্যতম কাজ হলো এই গোষ্ঠীতন্ত্র গড়ে ওঠার সংস্কৃতির বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, চ্যালেঞ্জ করা।
আমাদের এখানে একটা বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক কাঠামো কাজ করছে। এটা ভাঙা খুব জরুরি। এটা অক্ষত রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন প্রায় অসম্ভব