মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে সংকট নিরসনে সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সোমবার কক্সবাজারের হোটেল বে ওয়াচে রোহিঙ্গা ইস্যুতে অংশীজন সংলাপে তিনি এ প্রস্তাব তুলে ধরেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘২০১৭ সালের এই দিনে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে জীবন বাঁচাতে বাাংলাদেশে চলে আসে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এখনও আমরা নতুন করে রোহিঙ্গাদের আগমন দেখতে পাচ্ছি প্রতিদিন। এ রকম একটা দিনে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ইতিহাসের সঠিক পথে অবস্থান নেওয়া এবং জাতিগত নিধন বন্ধ করানো।’
যে সাতটি প্রস্তাব তুলে ধরেন তার প্রথমটিতে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিরাপদে ফিরে যেতে হবে। এ জন্য আমরা সবাইকে আহ্বান জানাবো, তাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনে একটি বাস্তব রোডম্যাপ যত দ্রুত সম্ভব তৈরি করুন। আর সময় নষ্ট না করে এখনই কাজ করতে হবে।’
দ্বিতীয়ত, ‘জীবন রক্ষাকারী কাজ চলমান রাখতে দাতাসংস্থা ও আন্তর্জাতিক অংশীজনদের অপিরিমিত অবদান এখানে প্রয়োজন। আমরা আহ্বান জানাচ্ছি, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাকে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার। একই সময়ে আমরা অংশীজনদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, ভবিষ্যতের জন্য পর্যাপ্ত ও টেকসই অর্থায়ন করার পদক্ষেপ নিতে।’
তৃতীয়ত, ‘রোহিঙ্গাদের প্রতি সব ধরনের নিপীড়ন এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। আমরা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এবং আরাকান আর্মির প্রতি আহ্বান জানাই রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত করার। আর কোনও রোহিঙ্গা যাতে বাংলাদেশে না আসে তা মিয়ানমারকে নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারের অভ্যন্তর বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজেদের বাড়িতে ফিরতে দিতে হবে।’
চতুর্থত, ‘মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সহিংসতা বন্ধে, জাতিগত নিপীড়ন রোধে পরামর্শ কিংবা সংলাপের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। আমরা মিয়ানমার সরকার এবং রাখাইন কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাই রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিতে, স্বেচ্ছায় নিরাপদ প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার।’
পঞ্চমত, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা বিশেষ করে আসিয়ানকে রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। আপনাদের সবার সহযোগিতা এই সংকটের সমাপ্তি টানতে পারে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সচল হওয়ার আহ্বান জানাই।’
ষষ্ঠত, ‘আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীজনদের অবশ্যই জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।’
সপ্তমত, ‘আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানাই ন্যায়বিচার, দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে এবং গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে। এখনই সময় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার উৎপত্তি মিয়ানমারে, এর সমাধানও মিয়ানমারে। সবাইকে এই সংকট নিরসনে কোনও বিলম্ব ছাড়াই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আপনাদের সোচ্চার হওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার আশা সঞ্চার করতে পারে।’
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের চোখে এখনও ভীতি দেখি, যখন তারা তাদের ওপর হয়ে যাওয়া অবর্ণনীয় ঘটনাগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরেন। ২০১৭ সাল এবং তারও আগে বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের এমন পরিস্থিতিতে আমরা চুপচাপ বসে থাকতে পারি না। আন্তর্জাতিক মহলের এখানে আগের চেয়েও বেশি প্রভাব বিস্তার করা প্রয়োজন। আমি আন্তর্জাতিক সংস্থা, অংশীজন, দাতাসংস্থাগুলোর অব্যাহত প্রচেষ্টার প্রশংসা করি। আপনাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা রোহিঙ্গাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি যতদিন না তারা বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন মিয়ানমার থেকে বাস্ত্যুচ্যুত প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিচ্ছে; যে কারণে কক্সবাজার এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি বছর ২২ হাজার শিশু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে। ৫ লাখের কম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বর্তমানে মিয়ানমারে অবস্থান করছে। এই চিত্র প্রমাণ করে যে, প্রতিনিয়ত নিপীড়নের কারণে রোহিঙ্গারা সে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। গত ৮ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে এই কক্সবাজার অঞ্চলের মানুষ উল্লেখযোগ্য ত্যাগ স্বীকার করেছে। আমাদের অর্থনীতি, সম্পদ, পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান, সমাজ এবং সুশাসনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ সম্পদকে আর ব্যবহার করার কোনও সুযোগ দেখছি না। রোহিঙ্গা ইস্যু এবং টেকসই সমাধান বৈশ্বিক এজেন্ডায় জিইয়ে রাখতে হবে যতদিন না তারা নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত কাজ করছে। এই সংলাপ রোহিঙ্গাদের আওয়াজ আরও জোরালো করছে এবং দ্রুত, টেকসই এবং নিরাপদ প্রত্যাবাসনের রোডম্যাপ তৈরি করছে। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান শুধু বাংলাদেশের একার কাজ নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও এখানে এগিয়ে আসতে হবে।’